‘জারা’ অর্থ মরুভূমির সুগন্ধি ফুল; মরুভূমির সুগন্ধি ফুলের মতোই সিলেটেও এক জারা এই ক্রান্তিকালে সুগন্ধ ছড়িয়ে যাচ্ছে - বাবা, মা ও দিদির সাথে সেও প্রতিদিন অংশ নিচ্ছে বন্যা দুর্গতদের মধ্যে ত্রাণ বিতরণের কাজে। নোংরা-ময়লা পানি ভেঙে, প্যাচ প্যাচে কাঁদা মাড়িয়ে দুর্গতদের দোরগোড়ায় ত্রাণ নিয়ে যাওয়ার সময় জারাও সঙ্গী হচ্ছে তার বাবা মায়ের সাথে, দিদিকে পাশে নিয়ে।

সিলেট শহরে দ্বিতীয় দফায় হওয়া এই বন্যায় এমনটিই দেখা যাচ্ছে প্রতিদিনের ত্রাণ কার্য পর্যবেক্ষণ করে। ২০২২ সালের সিলেটে সংঘটিত এই বন্যায় জারাই সম্ভবতঃ সর্বকনিষ্ঠ ত্রাণকর্মী হিসাবে সশরীরে কাজ করছে, প্রতিনিয়ত ত্রাণ নিয়ে ছুটে চলছে অসহায় - বন্যার্তদের দুয়ারে দুয়ারে।


পুরো নাম জারতাজ জাফিরাহ জারা। পড়াশোনা করছে স্কলার্সহোম শিবগঞ্জ ক্যাম্পাসের স্ট্যান্ডার্ড টুয়ে। পড়াশোনায় বরাবরই মেধাবী জারা নাচ-গান-আবৃত্তি-অভিনয়েও সমান দক্ষতার স্বাক্ষর রেখেছে ইতিমধ্যে। বাংলাদেশ টেলিভিশনে বেশ কয়েকবার অনুষ্ঠান প্রচারিত হয়েছে তার, অসংখ্য পুরস্কার অর্জনের পাশাপাশি বিভিন্ন উত্সব-অনুষ্ঠানে মঞ্চেও রয়েছে জারার সরব পদচারণা। জেলা শিল্পকলা একাডেমীর পাশাপাশি জারা একাধিক সাংস্কৃতিক সংগঠনের সাথেও জড়িত। ইংরেজি ভাষায় ঈর্ষণীয় দক্ষতা রয়েছে জারার; আবার, বাংলা আবৃত্তিতেও পেয়েছে শ্রেষ্ঠত্বের শিরোপা।

লেখালেখির জগতে আশিক শাওন নামে পরিচিত সিলেটের সুপরিচিত আশিক স্যার জারার বাবা। তিনি বিসিএস সাধারণ শিক্ষা ক্যাডারের সদস্য। জারার মা শারমিন সুলতানাও একজন শিক্ষক; বাংলাদেশ ব্যাংক স্কুলে দীর্ঘদিন ধরে শিক্ষকতা করছেন তিনি। দুই বোনের মধ্যে ছোট জারার বড় বোন জাওয়াতা আফনান রোজা সিলেটের সাংস্কৃতিক জগতের অন্যতম পরিচিত মুখ। কেবল সিলেটেই নয়, রোজার পরিচিতি রয়েছে পুরো দেশব্যাপী- টেলিভিশন ও মঞ্চেও নিয়মিত সে। শিক্ষক পিতামাতার আদর্শ আর সংস্কৃতিমনা দিদির আবহে গড়ে ওঠা জারা তাই মানবিকতার পাশাপাশি সংস্কৃতি চর্চাতেও সিদ্ধ।

২০০৪’এর পর এবারই প্রথম সিলেট শহরে বন্যার পানি প্রবেশ করলো-অতীতের সকল রেকর্ড ভঙ্গ করে। এই দুঃসময়ে জারার বাবা মা নিজেদের বন্ধু-বান্ধবী আর আত্মীয়-স্বজনদের মাধ্যমে যতসামান্য তহবিল গড়ে তা নিয়েই ঝাপিয়ে পড়ে দুর্গতদের ত্রাণ বিতরণে। মা বাবার এই উদ্বেগ-উত্কন্ঠা ছুয়ে যায় ছোট্ট জারাকেও; দিদির নিকট সে প্রস্তাব দেয়, “দিদি, আসো, আমরাও দাদু-নানুর দেয়া টাকাগুলো বাবা মাকে দিয়ে দেই; আর, আমরাও ফ্লাড এফেক্টেডদের হেল্প করি।’’

ছোটবোনের এই সিদ্ধান্তে সানন্দে রাজী হয়ে যায় রোজাও; বাবা মাকে তুলে দেয় তাদের জমানো ২,৭৩৫ টাকা, যা দিয়ে তাদের বাবা ১৮ তারিখেই শাহপরান সরকারি কলেজে আশ্রয় নেয়া ১৯টি পরিবারকে শুকনো খাবার সহায়তা করে। এভাবেই শুরু জারার বন্যার্তদের সহায়তায় নেমে পড়ার।

রবিবার (১৯ জুন) থেকে প্রতিদিন সশরীরে ত্রাণ কাজে অংশ নেয়া জারার সবচেয়ে ভালো লেগেছে বাংলাদেশের মহান স্বাধীনতা যুদ্ধে অংশ নেয়া বীর মুক্তিযোদ্ধাদের বাসায় বাসায় গিয়ে ত্রাণ সহায়তা করার কাজটি। এতোজন ফ্রিডম ফাইটারকে কাছ থেকে দেখার অনুভূতিতে এখনও আবিষ্ট হয়ে থাকা জারা সবসময়ই ফ্রিডম ফাইটারদের জন্য কিছু না-কিছু করবে বলে জানিয়েছে তার বাবা মাকে; তাদেরকে নতুন পোষাকও কিনে দেবে সে। ত্রাণ দেয়ার সময় তার সবচেয়ে ভালো লাগে বেবিদের- মিল পেয়ে তারা হ্যাপি হলে সে খুব প্লেজার ফিল করে এবং এটা দেখার জন্যই সে বাসার বসে না-থেকে বরং সবসময় বাবা মায়ের সাথে নিজেও আসে বন্যার্তদের সহায়তা করতে।

“সব মানুষকে অনেক হেল্প করতে চাই” - এমনটাই জারার মনোভাব। বন্যার সময় ছাড়াও অন্যসময়ও অসহায় আর্তপীড়িতদের জন্য কিছু একটা করতে উদগ্রীব ছোট্ট জারার মতো আমাদের দেশের সকল শিশু এগিয়ে এলে একদিন এই দেশ নিশ্চয় সোনার বাংলা হবে।


সিলেটভিউ২৪ডটকম/পিডি