গতকাল পৃথকভাবে কর্মসূচি পালন করে মহানগর বিএনপি। বায়ে আহ্বায়ক পক্ষ, ডানে সদস্যসচিব পক্ষ।

মেয়াদোত্তীর্ণ কমিটি ভেঙে দিয়ে প্রায় ১০ মাস আগে গঠন করা হয়েছিল সিলেট মহানগর বিএনপির আহ্বায়ক কমিটি। এই দীর্ঘ সময়ে আহ্বায়ক কমিটির দায়িত্বশীলরা তাদের আওতাধীন সকল ওয়ার্ডে কমিটিই গঠন করতে পারেননি। মহানগর বিএনপির সম্মেলন কবে হবে, তাও অনিশ্চিত। কিন্তু নেতারা নিজেদের মধ্যে বিরোধে জড়িয়েছেন আর সেই বিরোধ যে চরমে পৌঁছে গেছে, তা এখন ‘নিশ্চিত’!

বিএনপি নেতারা জানান, ২০১৬ সালের ৭ ফেব্রুয়ারি সিলেট জেলা ও মহানগর বিএনপির সর্বশেষ সম্মেলন হয়েছিল দলটির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরের উপস্থিতিতে। সম্মেলনে মহানগর বিএনপির সভাপতি নির্বাচিত হন নাসিম হোসাইন, সাধারণ সম্পাদক হন বদরুজ্জামান সেলিম এবং সাংগঠনিক সম্পাদক হন মিফতাহ সিদ্দিকী। তবে জেলা কিংবা মহানগর, কোনো ইউনিটেরই পূর্ণাঙ্গ কমিটি গঠন হয়নি সেই সম্মেলনে। সম্মেলনের প্রায় ১৪ মাস পর, ২০১৭ সালের ২৬ এপ্রিল সিলেট জেলা ও মহানগর বিএনপির পূর্ণাঙ্গ কমিটি গঠিত হয়।


দুই বছর মেয়াদের জন্য ওই পূর্ণাঙ্গ কমিটি অনুমোদন পায়। সেই মেয়াদ পেরিয়ে যায় ২০১৯ সালের এপ্রিলে। এরপর থেকে মেয়াদোত্তীর্ণ কমিটি দিয়ে চলছিল মহানগর বিএনপি। ২০২১ সালের ২৯ সেপ্টেম্বর মহানগর বিএনপির ২৯ সদস্যবিশিষ্ট আহ্বায়ক কমিটি গঠন করা হয়। আগের কমিটির সহসভাপতি আবদুল কাইয়ুম জালালী পংকীকে আহ্বায়ক ও আগের কমিটির সাংগঠনিক সম্পাদক মিফতাহ সিদ্দিকীকে সদস্যসচিব করা হয়।

কিন্তু আহ্বায়ক কমিটি ঘিরে শুরুতেই দেখা দেয় বিতর্ক। সেই বিতর্ককে ধামাচাপা দিতে আহ্বায়ক কমিটিতে অন্তর্ভূক্ত করা হয় আরও ৬ নেতাকে। বর্তমানে ৩৫ সদস্যের এ কমিটিতে আহ্বায়ক ও সদস্যসচিব ছাড়া যুগ্ম আহ্বায়ক ১৩ জন ও সদস্য ২০ জন রয়েছেন।

বিএনপি সূত্র জানায়, মহানগর বিএনপির আহ্বায়ক কমিটিতে মিফতাহ সিদ্দিকীকে সদস্যসচিব করা নিয়ে দলের একটি অংশ ক্ষুব্ধ হয়। তাঁকে ‘জুনিয়র’ ‘স্বার্থপর’ নেতা হিসেবে আখ্যায়িত করে ওই পক্ষ। মূলত বিএনপি চেয়ারপার্সনের উপদেষ্টা খন্দকার আব্দুল মুক্তাদির বলয় থেকে ওঠে এমন অভিযোগ।

মুক্তাদির বলয়ের নেতা হিসেবে পরিচিত মহানগর বিএনপির আহ্বায়ক আবদুল কাইয়ুম জালালী পংকী। অন্যদিকে বিএনপির নির্বাহী কমিটির সদস্য ও সিলেট সিটি করপোরেশনের মেয়র আরিফুল হক চৌধুরীর বলয়ের হিসেবে পরিচিত মহানগরের সদস্যসচিব মিফতাহ সিদ্দিকী। মুক্তাদির বলয়ের সঙ্গে আরিফ বলয়ের রেষারেষি আছে বলে জানিয়েছেন বিএনপি নেতারা।

বিএনপি সূত্র জানায়, গত ১৮ জুলাই রাতে আহ্বায়ক আবদুল কাইয়ুম জালালী পংকীর বাসায় মহানগর বিএনপির বর্ধিত সভা ছিল। সেই সভায় সদস্যসচিব মিফতাহ সিদ্দিকীর বিরুদ্ধে ক্ষোভের বিস্ফোরণ ঘটান একাধিক যুগ্ম আহ্বায়ক। তাঁরা মিফতাহ সিদ্দিকীর বিরুদ্ধে ‘স্বার্থপরতা’ ‘নিজের বলয় ভারী করা’ ‘দলে ভাঙন ধরানোর চেষ্টা’ প্রভৃতি অভিযোগ তুলে বক্তব্য দেন। এ নিয়ে বর্ধিত সভায় তুমুল হট্টগোল হয়। নিজের অবস্থান ব্যাখ্যা করে মিফতাহ সিদ্দিকী বক্তব্য দিতে গেলে তাঁকে থামিয়ে দেন ক্ষুব্ধ নেতারা। পরে আহ্বায়কসহ জ্যেষ্ঠ নেতাদের হস্তক্ষেপে শান্ত হয় পরিস্থিতি।

তবে ওই ঘটনায় ফুঁসে ওঠেন মিফতাহ সিদ্দিকীর অনুসারীরা। গত ৩০ জুলাই ‘লাগামহীন লোডশেডিং এবং বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতে অব্যবস্থাপনা’ নিয়ে সিলেটে প্রতিবাদ সমাবেশ করে মহানগর বিএনপি। নগরীর কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার প্রাঙ্গনে হওয়া সেই সমাবেশে উপস্থিত হননি সদস্যসচিব মিফতাহ সিদ্দিকী। তাঁর অনুসারীদের অনেকেই যাননি সেই সমাবেশে। তবে অনুপস্থিতির পেছনে ‘নিজের অসুস্থতা’র কথা বলেন মিফতাহ।

এদিকে, মহানগর বিএনপির বিরোধের সর্বশেষ নজির দেখা গেছে গতকাল মঙ্গলবার। ভোলায় পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষে গুলিতে বিএনপি নেতা আব্দুর রহিম নিহত হওয়ার প্রতিবাদে কেন্দ্রীয় কর্মসূচির অংশ হিসেবে মঙ্গলবার সিলেটে বিক্ষোভ সমাবেশের আয়োজন করে মহানগর বিএনপি। এই কর্মসূচি আলাদাভাবে করেছে মহানগর বিএনপির আহ্বায়ক পক্ষ ও সদস্যসচিব পক্ষ।

বিকাল সাড়ে ৩টায় রেজিস্টারি মাঠে বিক্ষোভ সমাবেশ শুরুর কথা ছিল। সমাবেশে সঞ্চালনা কে করবেন, এ নিয়ে দেখা দেয় মতবিরোধ। আহ্বায়ক পক্ষের মত ছিল, সঞ্চালনা করবেন সদস্যসচিব ও একজন যুগ্ম আহ্বায়ক। কিন্তু সদস্যসচিব পক্ষ দাবি করেন, সাংগঠনিক বিধি অনুসারে সদস্যসচিব একাই সঞ্চালনা করবেন। নিজেদের দাবি নিয়ে উভয়পক্ষ অনড় অবস্থান গ্রহণ করে। একপর্যায়ে ক্ষুব্ধ হয়ে মিফতাহ সিদ্দিকী ও তাঁর অনুসারীরা সমাবেশস্থল ত্যাগ করেন।

পরে উভয়পক্ষ সংবাদমাধ্যমে পৃথক সংবাদবিজ্ঞপ্তি পাঠায়। আহ্বায়ক কমিটির সদস্য নুরুল আলম সিদ্দিকী খালেদ স্বাক্ষরিত বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, মহানগর বিএনপির বিক্ষোভ সমাবেশ রেজিস্টারি মাঠে অনুষ্ঠিত হয়েছে। এ সমাবেশে আহ্বায়ক আবদুল কাইয়ুম জালালী পংকীর সভাপতিত্বে ও যুগ্ম আহবায়ক রেজাউল হাসান কয়েস লোদীর সঞ্চালনায় বক্তব্য রাখেন মহানগর বিএনপির সাবেক সভাপতি নাসিম হোসেন, যুগ্ম আহ্বায়ক হুমায়ুন কবির শাহীন, জিয়াউল গণি আরেফিন জিল্লুর, নজিবুর রহমান নজিব, সদস্য সৈয়দ তৌফিকুল হাদি, হুমায়ুন আহমদ মাসুক, নুরুল আলম সিদ্দিকী খালেদ, আফজল উদ্দিন, শামীম মজুমদার, সৈয়দ সাফেক মাহবুব, মহানগর মহিলা দলের সাবেক সাধারণ সম্পাদক নিগার সুলতানা ডেইজি প্রমুখ।

অন্যদিকে, মিফতাহ সিদ্দিকী স্বাক্ষরিত বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, তাদের বিক্ষোভ মিছিল আলিয়া মাদরাসা থেকে শুরু হয়ে রেজিস্টারি মাঠে গিয়ে শেষ হয়। এ মিছিলের পূর্বে সমাবেশ অনুষ্ঠিত হয়। এতে সদস্যসচিব মিফতাহ সিদ্দিকী ছাড়াও যুগ্ম আহবায়ক এডভোকেট হাবিবুর রহমান হাবিব, সুদীপ রঞ্জন সেন বাপ্পু, রুকশানা বেগম শাহনাজ, সালেহ আহমদ খসরু প্রমুখ উপস্থিত ছিলেন।

জানতে চাইলে সিলেট মহানগর বিএনপির সদস্যসচিব মিফতাহ সিদ্দিকী সিলেটভিউকে বলেন, ‘(গতকাল) একসাথে কর্মসূচি হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু সামান্য সমস্যা হওয়ার কারণে পৃথকভাবে কর্মসূচি হয়েছে।’

তিনি বলেন, ‘কিছু সমস্যার সৃষ্টি হয়েছে। এগুলো দূরীভূত হয়ে আগামীতে একসাথে কাজ করবে মহানগর বিএনপি।’

বিরোধ প্রসঙ্গে মহানগর বিএনপির আহ্বায়ক আবদুল কাইয়ুম জালালী পংকী সিলেটভিউকে বলেন, ‘দলে বড় কোনো সমস্যা নেই।’

গতকালের কর্মসূচি পৃথক হওয়া প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘সমাবেশ পরিচালনা নিয়ে সমস্যা হয়। মিফতাহ সিদ্দিকীর সঙ্গে সহযোগিতার জন্য একজনকে দেওয়া হয়েছিল।’

এদিকে, মহানগর বিএনপির আওতাধীন ২৭টি ওয়ার্ড কমিটির মধ্যে ১৭টিতে আহ্বায়ক কমিটি গঠন করে দেওয়া হয়েছে বলে জানিয়েছেন মিফতাহ সিদ্দিকী। তিনি জানান, আরও ২টি কমিটি মোটামুটি প্রস্তুত রয়েছে। বাকিগুলোর কাজ চলছে।

আবদুল কাইয়ুম জালালী পংকী জানিয়েছেন, চলতি মাসের মধ্যে নগর বিএনপির সব ওয়ার্ডে আহ্বায়ক কমিটি গঠন সম্পন্ন করতে চান তারা।

সিলেটভিউ২৪ডটকম/আরআই-কে