সব্যসাচী লেখক সৈয়দ শামসুল হক 'মুছে ফ্যালো মিছে অশ্রু তোমার' কবিতায় লিখেছেন- 'মুজিব মরে না, মরেনি মুজিব কোনো বুলেটের ঘায়। বুলেটে পতিত দেহই কেবল, অমর সে আত্মায়।/ মুছে ফ্যালো মিছে অশ্রু তোমার, আজো এই বাংলায়/ কুটিরে পাথারে নগরে ও গ্রামে পায়ে পায়ে হেঁটে যায়-/ অবিরাম হেঁটে চলেছে মুজিব রক্তচাদর গায়।/ মুজিব! মুজিব! জনকের নাম এত সহজেই মোছা যায়!'  বাঙালির হাজার বছরের ইতিহাসের মধ্যে বঙ্গবন্ধু হচ্ছেন সেই নেতা, যিনি বাঙালিকে দিয়েছেন একটি দেশ, একটি পতাকা, একটি মানচিত্র। একটি সঙ্গীত ‘আমার সোনার বাংলা আমি তোমায় ভালোবাসি।’ তাই তো তিনি হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি। পল্লী কবি জসীম উদ্দিনের ভাষায়, ‘মুজিবর রহমান/ ওই নাম যেন বিসুভিয়াসের অগ্নি-উদারী বান।’

দিন যতই যাচ্ছে, বাঙালির কাছে বঙ্গবন্ধুর অপরিহার্যতা আরো বাড়ছে। শতবর্ষে বঙ্গবন্ধু আরও বেশি উজ্জ¦ল, জ্যোর্তিময়। পাকিস্তানের দুঃশাসনের অমানিশায় তিনি আলোর দূত হয়ে এসেছিলেন, বাতিঘর হয়ে। তার হাত ধরেই বাঙালি পায় মুক্তির স্বাদ। তাইতো বাঙালি ভালবেসে তাকে দিয়েছে ’বঙ্গবন্ধু’ খেতাব আর স্বাধীন বাংলাদেশের সংবিধান তাকে দিয়েছে ’জাতির পিতা’র স্বীকৃতি। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি সে মহামানবকে একদল হায়েনার হাতে প্রাণ দিতে হয়েছে। দেশীয় একদল মিরজাফর আর আন্তর্জাতিক চক্রান্তে তাকে শাহাদাত বরণ করতে হয়। আজ সে শোকের দিন, বাঙালির ইতিহাসের সবচেয়ে বেদনাবিধুর দিন, জাতীয় শোক দিবস।  


শেখ মুজিবুর রহমানের জন্ম ১৯২০ সালের ১৭ মার্চ বর্তমান গোপালগঞ্জ জেলার টুঙ্গিপাড়ায়, শেখ লুৎফর রহমান ও সায়েরা খাতুনের ঘরে। বাবা-মা আদর করে ডাকতেন ‘খোকা’ বলে। এই খোকাই কালে হয়ে ওঠেন ইতিহাসের মহানায়ক। ছোটবেলায় দুরন্ত স্বভাবের ছিলেন শেখ মুজিব, তার নিজের ভাষায় ‘দুষ্টু প্রকৃতির’। শৈশবে বেরিবেরি রোগ হওয়ার পর হৃদযন্ত্র হয়ে পড়েছিল দুর্বল, গ্লুকোমা হওয়ায় অস্ত্রোপচারের পর চোখেও উঠেছিল চশমা। তার মধ্যেও ফুটবল নিয়ে মাঠ মাতাতেন তিনি। গিমাডাঙ্গা প্রাথমিক বিদ্যালয়, গোপালগঞ্জ পাবলিক স্কুল, মিশনারি স্কুলে পড়াশোনার সময়ই রাজনীতির দীক্ষা হয়ে যায় শেখ মুজিবের। স্কুলে পড়াকালেই ‘মুসলিম সেবা সমিতির’ সক্রিয় সদস্য হিসেবে কাজ শুরু করেন। সমিতির পক্ষ থেকে মুসলমানদের বাড়ি থেকে সংগৃহীত ’মুষ্টিভিক্ষার চাল’ এর অর্থ দিয়ে গরিব ছাত্রদের পড়ালেখাসহ অন্যান্য খরচের জোগান দেওয়া হত। ১৯৩৮ সালে অবিভক্ত বাংলার মুখ্যমন্ত্রী এ কে ফজলুল হক ও শ্রমমন্ত্রী হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর গোপালগঞ্জ সফরে তাদের সংবর্ধনা দেন শেখ মুজিব।শিক্ষার্থীদের দাবি নিয়েও সোচ্চার ছিলেন তিনি। তখনই সোহরাওয়ার্দীর সঙ্গে তার যোগাযোগের শুরু। পরে বেঙ্গল মুসলিম ছাত্রলীগ গোপালগঞ্জ  মহকুমার সম্পাদক হন। অল বেঙ্গল মুসলিম ছাত্রলীগের ফরিদপুর জেলা ও প্রাদেশিক কাউন্সিলরও হন তিনি। বেঙ্গল মুসলিম ছাত্র ফেডারেশনের কাউন্সিলর নির্বাচিত হন ১৯৪১ সালে ১ বছরের জন্য। ওই বছরই তিনি দুই বার সাময়িকভাবে গ্রেপ্তার হন। 

১৯৪২ সালে ম্যাট্রিকুলেশন পাস করে কলকাতা ইসলামিয়া কলেজে (বর্তমানে মৌলানা আজাদ কলেজ) ভর্তি হন শেখ মুজিব। তার রাজনৈতিক তৎপরতা বাড়তে থাকে। কলেজ ছাত্র সংসদের জিএস নির্বাচিত হন ১৯৪৬ সালে। ১৯৪৭ সালে এই কলেজ থেকেই তিনি স্নাতক ডিগ্রি নেন।ভারত এবং পাকিস্তানের পাশাপাশি তৃতীয় রাষ্ট্র হিসেবে বাংলা প্রতিষ্ঠার জন্য ১৯৪৭ সালে সোহরাওয়ার্দীর সঙ্গে আন্দোলনে যোগ দেন শেখ মুজিব। এই উদ্যোগ ব্যর্থ হলেও পরবর্তীতে এটাই তার স্বপ্নের রাষ্ট্র গড়ার ভিত্তি গড়ে দেয়।

ভারত ভাগের পর পূর্ব পাকিস্তানে ফিরে ১৯৪৮ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগে ভর্তি হন শেখ মুজিব; প্রতিষ্ঠা করেন পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগ, সোচ্চার হন পাকিস্তান সরকারের দমন-পীড়নের বিরুদ্ধে। উর্দুকে পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা করার জন্য মুসলিম লীগের চক্রান্তের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ান শেখ মুজিব; রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবিতে ধর্মঘট পালন করতে গিয়ে গ্রেপ্তার হন, পরে ছাড়াও পান। চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারীদের অধিকার আদায়ে নেমে গ্রেপ্তার হয়ে কারাগারে থাকা অবস্থায় ১৯৫২ সালের ভাষাআন্দোলনে নানা দিক-নির্দেশো দেন। ১৯৪৯ সালের ২৩ জুন পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগ (বর্তমান আওয়ামী লীগ) গঠন হলে কারাগারে বন্দি অবস্থাতেই যুগ্ম সম্পাদক নির্বাচিত হন শেখ মুজিব। এর মধ্যদিয়ে বিকশিত হতে থাকে তার রাজনৈতিক নেতৃত্ব।

১৯৫৪ সালের প্রাদেশিক সরকারের নির্বাচনে যুক্তফ্রন্ট ক্ষমতায় গেলে গোপালগঞ্জ থেকে নির্বাচিত শেখ মুজিব সর্বকনিষ্ঠ সদস্য হিসেবে মন্ত্রিসভায় যোগ দেন; যদিও এক বছরও সেই সরকারকে থাকতে দেয়নি পাকিস্তানি শাসক গোষ্ঠী। অসাম্প্রদায়িক শেখ মুজিব ১৯৫৫ সালে সাধারণ সম্পাদক হিসেবে দলের নাম থেকে ‘মুসলিম’ শব্দটি বাদ দিয়ে 'আওয়ামী লীগ' করতে মূল ভূমিকা পালন করেন। আর এই আওয়ামী লীগই হয়ে ওঠে তার ধ্যান-জ্ঞান। যার জন্য পরে আবার প্রাদেশিক সরকারের মন্ত্রী হলেও দলকে সুসংহত করার উদ্দেশ্যে মাত্র নয় মাস পর পদত্যাগ করেন তিনি।এরপর আইয়ুব খানের সামরিক শাসনে কারাগারেই কাটাতে হয় শেখ মুজিবকে; কিন্তু তা বাঙালির নেতা হিসেবে তার ভিত্তি আরও মজবুত করে তোলে। এই সময় ‘স্বাধীন বাংলা বিপ্লবী পরিষদ’ নামে একটি গোপন সংগঠনও প্রতিষ্ঠা করেন তিনি।

বাংলাদেশ ছাত্রলীগের জাতীয় সম্মেলনে প্রধান অতিথি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। ষাটের দশকে বাঙালির রাজনৈতিক সংগ্রাম তুঙ্গে উঠলে তার অবিসংবাদিত নেতা হয়ে ওঠেন শেখ মুজিব। ১৯৬৬ সালে বাংলার শোষণ-বঞ্চনার অবসান দেন ৬ দফা, যা তখন জাতীয় মুক্তির সনদ হিসেবে গ্রহণ করে বাঙালি। এই ছয় দফা বাঙালি জাতির জন্য অর্থনৈতিক ও সামাজিক মুক্তির বীজ যেমন বুনে দেয়, তেমনি পাকিস্তানি ঔপনিবেশিক শাসনের গোড়ায় হানে আঘাত। ছয় দফার পক্ষে ব্যাপক জনমত গড়ে উঠলে পাকিস্তানি শাসক গোষ্ঠী প্রথমে বন্দি করে শেখ মুজিবকে; এরপর করে ‘আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা’। কিন্তু শেখ মুজিবের মুক্তি দাবিতে দেশব্যাপী শুরু হয় তীব্র ছাত্র গণআন্দোলন, যাতে ভিত কেঁপে ওঠে আইয়ুব শাহীর। ১৯৬৯ সালের ২২ ফেব্রুয়ারি শেখ মুজিবসহ রাজবন্দিরা মুক্তি পেলে পরদিন রেসকোর্স ময়দানে (বর্তমানে সোহরাওয়ার্দী উদ্যান) এক বিশাল ছাত্র সমাবেশে লাখো শিক্ষার্থীর উপস্থিতিতে কেন্দ্রীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ শেখ মুজিবকে ‘বঙ্গবন্ধু’ উপাধিতে ভূষিত করে।

স্বায়ত্তশাসনের আন্দোলনকে ধীরে ধীরে স্বাধীনতা সংগ্রামের দিকে চালিত করতে থাকে বঙ্গবন্ধুর বিচক্ষণ নেতৃত্ব। ওই বছরের ৫ ডিসেম্বর সোহরাওয়ার্দীর মৃত্যুবার্ষিকী উপলক্ষে আয়োজিত আওয়ামী লীগের এক জনসভায় পূর্ব পাকিস্তানের নাম ‘বাংলাদেশ’ রাখেন তিনি। ১৯৭০ সালে পাকিস্তানের সাধারণ নির্বাচনে আওয়ামী লীগের নিরঙ্কুশ জয় তাকে কেন্দ্রীয় সরকারে বসার দাবিদার করলেও তা হতে দেয়নি পাকিস্তানিরা। যার ফলে নতুন দেশ গড়ার নিজের লালিত স্বপ্নের দিকে এগোতে থাকেন বঙ্গবন্ধু। 

আওয়ামী লীগকে ক্ষমতা হস্তান্তর না করে ১৯৭১ সালে পাকিস্তানের তৎকালীন প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান জাতীয় পরিষদের অধিবেশন অনির্দিষ্টকালের জন্য স্থগিত করলে ফুঁসে ওঠে বাঙালি। বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে স্বাধীনতার আকাঙ্খা গতি পায় ; কার্যত ১ মার্চ থেকে তার নির্দেশেই চলতে থাকে পূর্ব পাকিস্তান। পাকিস্তানিদের নানা ষড়যন্ত্রের মধ্যে ৭ মার্চ রেসকোর্স ময়দানে জনসমুদ্রে হাজির হন বঙ্গবন্ধু; বজ্রকণ্ঠে  ঘোষণা করেন ‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম’। বিশ্বের ইতিহাসে অন্যতম সেরা ভাষণ হিসেবে স্বীকৃত ওই ভাষণ থেকেই ‘স্বাধীনতা শব্দটি আমাদের হল’। প্রয়াত অধ্যাপক আনিসুজ্জামান বলেছিলেন, “যে শুনেছে সেই ভাষণ, তার শরীরে বয়ে গেছে বিদ্যুৎ প্রবাহ।”

বঙ্গবন্ধুর ডাকে সশস্ত্র স্বাধীনতা সংগ্রামের জন্য প্রস্তুতিতে নামে বাঙালি; অন্যদিকে পাকিস্তানিরাও চরম আঘাত হানার পরিকল্পনা নেয়। ২৫ মার্চ দিবাগত রাতে পাকিস্তানি বাহিনী গণহত্যা শুরু করলে গ্রেপ্তার হওয়ার আগে ২৬ মার্চের প্রথম প্রহরে বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করেন বঙ্গবন্ধু। পাকিস্তানি বন্দি বঙ্গবন্ধুকে রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত করে তার নেতৃত্বেই চলে স্বাধীনতার সংগ্রাম। নয় মাসের রক্তক্ষয়ী সংগ্রাম শেষে ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর বাংলাদেশ বিজয় লাভ করে। ১৯৭২ সালের ৮ জানুয়ারি বঙ্গবন্ধু পাকিস্তান কারাগার থেকে মুক্তি পেয়ে লন্ডন, নয়াদিল্লী হয়ে ১০ জানুয়ারি স্বাধীন বাংলাদেশে ফেরার পর পূর্ণতা পায় বাঙালির স্বাধীনতা।

যুদ্ধবিধ্বস্ত বাংলাদেশ পুনর্গঠনে রাষ্ট্রীয় নেতৃত্ব নিয়ে জাতির পিতা নামলেও ষড়যন্ত্র থেমে থাকেনি, তা চলতে থাকে দেশে এবং দেশের বাইরে। প্রথমে প্রধানমন্ত্রী হন শেখ মুজিব, কয়েক বছর পর ১৯৭৫ সালে বাকশাল গঠন করে প্রেসিডেন্ট হন তিনি। ওই বছরই ১৫ অগস্ট বাঙালি জাতির ইতিহাসে এক অন্ধকার রাত আসে, যাতে বাঙালি হারায় জাতির পিতাকে। স্বাধীন বাংলাদেশের জন্য সংগ্রামে যার জীবনের ৪ হাজার ৬৮২ দিন থাকতে হয়েছিল কারাগারে, জনগণকে প্রাধান্য দিতে পরিবার যার কাছে হয়ে পড়েছিল গৌন, সেই শেখ মুজিবের হন্তারক হিসেবে আবির্ভূত হন একদল বাঙালিই। বাঙালির প্রতি তার ছিল অগাধ বিশ্বাস; তিনি বলতেন, তিনি দেশের মানুষকে ভালোবাসেন, এটা তার শক্তি। আর তার দুর্বলতা হচ্ছে, তিনি দেশের মানুষকে ‘বেশি’ ভালোবাসেন। সেই দুর্বলতার সুযোগে পঁচাত্তরের ট্রাজেডি আসে বাংলাদেশে; যার জন্ম না হলে হয়ত বাংলাদেশ হত না বলা হয়, সেই বঙ্গবন্ধুর শেষ গোসল হয় একটি কাপড় কাচা সাবানে, কাফন হয় রিলিফের কাপড়ে। এর চেয়ে লজ্জ্বাজনক জাতির জন্যে আর কী হতে পারে!

ধর্ম নিরপেক্ষতা, জাতীয়তাবাদ, গণতন্ত্র ও সমাজতন্ত্র- এই চার মূল নীতি নিয়ে বঙ্গবন্ধু যে দেশ প্রতিষ্ঠা করেছিলেন, তার হত্যাকা-ের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশের পথচলা উল্টো দিকে বেঁকে যায়। বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে তার গোটা পরিবারকেই হত্যা করেছিল খুনি ওই সেনা সদস্যরা; বিদেশে থাকায় বেঁচে যান দুই মেয়ে শেখ হাসিনা ও শেখ রেহানা। প্রতিকূল পরিবেশে বাবার দলের দায়িত্ব নিয়ে দেশে আসেন শেখ হাসিনা; তখন নিজের গড়া দেশেই রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে নির্বাসিত বঙ্গবন্ধু। শত প্রতিবন্ধকতা পেরিয়ে শেখ হাসিনার নেতৃত্বে ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় ফেরার পর বঙ্গবন্ধু হত্যাকা-ের বিচারের উদ্যোগ নেওয়া হয়। ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ পুনরায় ফিরলে বিচার সম্পন্ন করে গ্রেপ্তার খুনিদের মৃত্যুদ- কার্যকর করা হয়। বঙ্গবন্ধুর আওয়ামী লীগের অর্থনৈতিক দর্শন বদলালেও তার স্বপ্নের সোনার বাংলা গড়ার লক্ষ্যেই এখন কাজ করার কথা বলছেন তার মেয়ে শেখ হাসিনা। ফলে জাতীয় জীবনে বঙ্গবন্ধু আছেন স্বমহিমায়। ’বাপ কা বেটি’ কন্যার সুযোগ্য নেতৃত্ব আর দূরদর্শীতায় বাংলাদেশ বর্তমানে বিশ্বদরবারে সম্মানজনক আসনে অধিষ্ঠিত হতে সক্ষম হয়েছে।  

১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারী রেসকোর্সের ভাষণে বলেছিলেন,’আজ থেকে আমার অনুরোধ, আজ থেকে আমার আদেশ, আজ থেকে আমার হুকুম ভাই হিসেবে, নেতা হিসেবে নয়, প্রেসিডেন্ট হিসেবে নয়, প্রধানমন্ত্রী হিসেবে নয়, আমি তোমাদের ভাই, তোমরা আমার ভাই, এই স্বাধীনতা ব্যর্থ হয়ে যাবে যদি আমার বাংলার মানুষ পেট ভরে ভাত না পায়। এই স্বাধীনতা আমার পূর্ণ হবে না যদি আমার বাংলার মা-বোনেরা কাপড় না পায়, এই স্বাধীনতা পূর্ণ হবে না। যদি এ দেশের মা- বোনেরা ইজ্জত ও কাপড় না পায়। এই স্বাধীনতা আমার পূর্ণতা হবে না যদি এ দেশের মানুষ, যারা আমার যুবক শ্রেণি আছে তারা চাকরি না পায় বা কাজ না পায়।’১৯৭৩ সালে আলজিয়ার্সে অনুষ্ঠিত জোটনিরপেক্ষ আন্দোলনের সম্মেলনে বঙ্গবন্ধু ঐতিহাসিক ভাষণে বলেছিলেন-‘বিশ্ব আজ দুই ভাগে বিভক্ত, এক পক্ষে শোষক, আরেক পক্ষে শোষিত। আমি শোষিতের পক্ষে।’

কিউবার বিপ্লবী নেতা ফিদেল ক্যাস্ট্রো বঙ্গবন্ধুকে বলেন, ‘আমি হিমালয় দেখিনি, কিন্তু শেখ মুজিবকে দেখেছি। ব্যক্তিত্ব ও সাহসিকতায় তিনি হিমালয়ের মতো।’ শোষক ও স্বেচ্ছাচারী শসকগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে জনগণকে ঐক্যবদ্ধ করতে বঙ্গবন্ধু পালন করেছেন ঐতিহাসিক ভূমিকা। পাকিস্তানি ঔপনিবেশিক শক্তির শৃঙ্খল থেকে তিনি বাঙালি জনগোষ্ঠীকে মুক্ত করে স্বাধীন দেশের স্বপ্ন দেখেছিলেন। আর জনগণকে সঙ্গে নিয়ে সেই স্বপ্ন তিনি বাস্তবায়ন করেছেন। এ মুক্তির সংগ্রামে তিনি নিজের জীবনকে তুচ্ছ করেছিলেন। কিশোর বয়স থেকেই প্রতিবাদী ছিলেন। সর্বদা সত্য ও ন্যায়ের কথা বলেছেন। সত্য ও ন্যায়ের পথ থেকে তিনি কখনও দূরে সরে যাননি। ভীতি ও অত্যাচারের মুখেও সর্বদা সত্য ও ন্যায়ের পথে থেকে শোষিত মানুষের অধিকারের কথা বলেছেন। আর এভাবেই তিনি হয়ে ওঠেন স্বাধীনতার মূর্ত প্রতীক। শোষিত মানুষের পক্ষে নির্ভীক অবস্থানের কারণে তিনি কেবল বাংলাদেশ নয়, সারাবিশ্বে অবিসংবাদিত নেতা হিসেবে স্বীকৃতি পান।

বঙ্গবন্ধুর জীবন সবার জন্যই এক শিক্ষণীয় বিষয়। তার অপরিসীম ত্যাগ ও তিতিক্ষার জন্য আমরা একটি স্বাধীন দেশ পেয়েছি। স্বাধীন জাতি হিসেবে বিশ্ব দরবারে মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে পেরেছি। দেশের স্বাধীনতার জন্য তিনি যেমন আজীবন সংগ্রাম করে গেছেন তেমনি দেশের জন্য জীবন দিতেও কুণ্ঠাবোধ করেননি। তাই বাঙালি জাতি চিরকাল শ্রদ্ধা ও কৃতজ্ঞতার সঙ্গে তাকে স্মরণ করবে।

কবির ভাষায়, ‘ভেঙেছ দুয়ার,এসেছ জ্যোতির্ময়, তোমারি হউক জয়।
তিমিরবিদার উদার অভ্যুদয়, তোমারি হউক জয়।’

লেখক : কলামিস্ট ও পরিবেশকর্মী।