“শিক্ষিতদের মধ্যে আত্মহনন অধিক কেন”? এ রকম একটি প্রশ্ন মাত্র মাস-কয়েক পূর্বে পত্রিকান্তরে দেখেছিলাম। আমরা সকলেই যদি স্ব স্ব গা বাঁচিয়ে এ প্রশ্নের উত্তর দেই, তা হলে কোন সদোত্তরই পাওয়া যাবে না, বরং এটা হবে দায়ভার এড়িয়ে যাবার একটি ছোঁতো-মাত্র। আরও, ঐ প্রশ্নের নিচেই পুলিশের সন্দেহের কথা উল্লেখ করে ছাপা খবর বেরিয়েছিল দু’টি আত্মহত্যার। দু’য়ের একজন হচ্ছেন কোন এক জেলার এ্যডিশনাল এস পি, নারী, বয়স ৪০; ২য় জন কোন একটি থানার একজন পুরুষ-পুলিশ।
আমার নিজের কথা যদি আমি বলি, তা হলে দাঁড়াবে এরকমঃ আজ দেশে-বিদেশে সরকারি কলেজ ও পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রায় ৪৬ বছরের একজন আপাদমস্তক শিক্ষক আমি। একমাত্র, সিলেটের শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়েই একটানা প্রায় ২৮ বছর, ইংরেজি বিভাগের প্রতিষ্ঠাতা, জ্যেষ্ঠতম অধ্যাপক ও সব মিলিয়ে প্রায় ২৪ বছরের সাবেক বিভাগীয় প্রধান। বিদেশের একটিমাত্র প্রতিষ্ঠানে থেকেই ৭ বছর পড়িয়েছি প্রায় ১৪টি দেশের শিক্ষার্থীদের, বাদবাকি সময় দেশেই অধ্যাপনা। মানে, গোটা চাকুরি-জীবনটাই কাটিয়েছি ১৮/১৯ থেকে ২৬/২৭ বছর বয়সের প্রানোচ্ছল শিক্ষার্থীদের নিয়ে। তাই, এ দীর্ঘ সময়কালে এ বয়সী ছেলেমেয়েদের মেধা-মনন, চাওয়া-পাওয়া, আশা-ভরসা, হতাশা-নিরাশার সম্যকটুকুই তারা শেয়ার করেছে আমার সাথে, হয়ত বা এত অধিক কাল বিভাগীয় প্রধানের দায়িত্ব পালনের কারণে। আরেকটি বিভাগের অতিরিক্ত দায়িত্বে ছিলাম প্রায় একটানা আড়াই বছর, অপর একটি বিভাগের প্রধানের দায়িত্বে থাকতাম মাঝে-মধ্যে; আর, একটি আবাসিক ছাত্র-হলের সাথে সংশ্লিষ্ট ছিলাম দীর্ঘ ৭ বছর। অনেক কমিটি-উপকমিটি-তদন্তকমিটিতে দায়িত্ব পালন করতে হয়েছে এ সুদীর্ঘ চাকুরিজীবনে। অর্জন করতে পেরেছি তিক্ত-বিরক্ত, তিক্ত-মিষ্ট, চিত্র-বিচিত্র হরেক রকমের অভিজ্ঞতা। তাই, জাতীয় কবির ভাষায় বলতেই হয়ঃ “বন্ধুগো, বড় বিষজ্বালা এই বুকে/দেখিয়া-শুনিয়া ক্ষেপিয়া গিয়াছি/তাই, যাহা আসে কই মুখে…………..”।
উদাহরণস্বরূপ, আমরা প্রথমেই ধরে নিলাম বয়স্কদের আত্মহত্যার কথা। একবার পিত্রিকা-মারফত জেনেছিলাম, কোন্ এক থানার একজন পুলিশ-সদস্য ঐ থানার ভেতরেই উনার নিজ কক্ষে আত্মহত্যা করেছেন। আবার শুনেছিলাম, সিলেট গ্যাস-ফিল্ডের একজন বড় অফিসার নিজের একা কক্ষে আত্মহত্যা করেছেন। নিয়মিত পত্রিকা পড়ার মত এত ফ্রি সময় আমার নেই, তাই, না জানি আরও কত এ রকম খবর মিস্ করেছি। আমি যেটুকু জানিঃ গ্যাস-ফিল্ডে লম্বা বেতন। আর, লম্বা না খাটো বেতন, আমার দৃঢ় বিশ্বাসঃ এ সমস্থ আত্মহত্যার পেছনে টাকা কোন ব্যাপার নয়। আমাদের প্রয়াত প্রেসিডেন্ট এরশাদ (রঃ) সাহেব যখন ২য় বিয়ে করেন, তখন সারা দেশেই অনেক মুখরোচক কথা হয়েছে। ঠিক একই রকম কথাবার্তা হয়েছে আমাদের মরহুম পররাষ্ট্রমন্ত্রী সামাদ আজাদ (রঃ) এর ২য় বিয়ের সময়। অনুরূপ আলোচনাই হয়েছে আমাদের স্বনামধৈন্য লেখক হুমায়ূন আহমেদ (রঃ) কে নিয়ে-ও। এগুলোর সবই কুসংস্কার। একটিমাত্র আইন পাশ করেই এ সমস্থ কুংস্কার নির্মূল করা সম্ভব।
আমরা সকলেই জানিঃ হযরত ইব্রাহীম (আঃ) এর বৃদ্ধা স্ত্রী সারাহ কোন সন্তান জন্ম দিতে না পেরে তিনি স্বয়ং প্রিয় স্বামীকে প্রস্তাব দিয়েছিলেন আমাদের আম্মাজান, বিবাহযোগ্য হযরত হাজেরাকে, বিয়ে করার জন্য। আর প্রিয়তমা স্ত্রীর ঐ প্রস্তাব গ্রহণ করে এ বিয়ে করেই ৮৬ বছর বয়সে হযরত ইব্রাহীম (আঃ) পান হযরত ইসমাঈল (আঃ) কে। পরবর্তীতে আবার বিবি হাজেরার গর্ভেই জন্মগ্রহন করেন হযরত ইসহাক্ব (আঃ)। ইতিহাস তো জীবন্ত স্বাক্ষী।
বাংলাদেশের কোন একটি পালিক বিশ্ববিদ্যালয়ের ৬৭ বছর বয়সী একজন ভাইস চ্যান্সেলর তাঁর ২য় স্ত্রীর মাধ্যমে এক সন্তান লাভ করেন। এ নিয়ে ঐ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের মধ্যে কত হাস্যরসের আলাপ আমি শুনেছি। সমাজে এ রকম উদাহরণ কম বলেই ঐ রকম আলাপ সচরাচরই হয়। অথচ আজকের বিজ্ঞান বলছেঃ সাধারনতঃ পিতার বৃদ্ধ বয়সের সন্তানগণই অধিক মেধাবি ও অধিকতর দীর্ঘায়ূ হয়ে থাকে। বৈজ্ঞানিক গবেষণা-আবিষ্কার তো মানতেই হবে।
বস্তুতঃ, আমার স্বীয় পিএইচডি গবেষণা যেহেতু নারীর মনস্থাত্তিক বিষয়ের উপর, তাই, এ বিষয়ে কথা বলার অধিকার আমি অবশ্যই রাখি। একজন নারীর জৈবিক চাহিদা যদিও সাবালকত্ব অর্জন করার সাথে সথেই আরম্ভ হয়ে যায়, তবুও কুড়ি বছরের পূর্বে তা প্রকট আকার ধারন করে না। বিশেষ করে ২৫ থেকে ৩৫ বছর পর্যন্তই নারীর এ চাহিদা তুঙ্গে থাকে। তার পর থেকেই তার ঐ চাহিদার ঘাটতি/ছন্দপতন আরম্ভ হয়ে যায়। তাই, ৪০ থেকে ৫০ এর ভেতরের কোন এক সময়েই একজন নারীর মিড্ল্-এ্যজ ক্রাইসিস আরম্ভ হয় (অবশ্য ব্যতিক্রম ভিন্ন ব্যাপার)। নারী সাধারনতঃ তখন আর স্বামী-সঙ্গ তেমন চায় না, বরং এটাকে স্বাভাবিকভাবেই একটা নির্যাতন মনে করে। আর, চিকিৎসাবিজ্ঞানের ভাষায়, নারীর এ মিড্ল্-এ্যজ ক্রাইসিসটা-কে-ই বলা হয়েছে ‘মেনোপোজ’, যে সনয়টাতে একজন নারীর শরীরে নানাধেরনের রোগের বিভিন্ন উপসর্গ একটি নির্দিষ্ট সময়ের জন্য দেখা দেয়।
প্রাকৃতিক/শারীরিক/সৃষ্টিগত নিয়মেই/কারণেই একজন নারীর অবস্থা যদি এমন হয়, তা হলে একজন পুরুষের কী করবে? মূলতঃ এখান থেকেই স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে ঝগড়া-ঝাটি, কলহ, মনোমালিন্য, এমন কি স্ত্রীর গায়ে হাত তুলা, সম্পর্কের অবনতি, ইত্যাদি যাবতীয় কিছু। আবার স্ত্রীর চাকরী হয়ত ফরিদপুরে, আর ব্যাটা স্বামীর চাকুরি সিলেটে। সুতরাং, কাছে থাকলেও যেভাবে সঙ্গ মিলে না, বরং উল্টো পুরুষ-নির্যাতন, দূরে থেকেও তা। এভাবে কত দিন? এক পর্যায়ে আরম্ভ হয় নিঃসঙ্গতার চলমান রোগ, ফলশ্রুতিতে আসে আত্মহত্যার প্রবণতা। তাই, ঐ প্রশ্নের এক জবাব হচ্ছেঃ একাধিক বিয়ে সহজ-করণ, যদি স্বামীর সেই সার্বিক ক্ষমতা থাকে, এবং এই শর্তে যে, স্বামী একাধিক স্ত্রীর ক্ষেত্রে সমানাধিকার অবশ্যই নিশ্চিৎ ও রক্ষা করবে। এ অনুমতি দেবেন যৌথভাবে ওয়ার্ড-মেম্বার এবং ইউনিয়ন চেয়ারম্যান। তখন এই ক্ষমতার অপব্যবহার করে একজন নিম্নবর্গ-স্বামীর মত, যখন ইচ্ছা বিয়ে, আর মন চাইলেই তালাক – এ অবস্থার সৃষ্টি হবে না। পরিবারে/সমাজে একটা রেওয়াজ চালু হয়ে যাবে।
কিন্তু এখন, এই একচ্ছত্র ক্ষমতা এবং সার্বভৌমত্ব যদি শুধুই একমাত্র স্ত্রীর হাতেই থাকে, তাহলে যা হবার তা-ই হবে; কারণ, সার্বভৌমত্ব কেউ ভাগাভাগি করতে চায় না। ভাবটা যেন এমন, বেচারা স্বামী - তুই গোল্লায় যা, আমি তো ভাল আছি। এজন্যই চির-আধুনিক মহাবিজ্ঞান-গ্রন্থ আল-ক্বোরআন এই ক্ষমতা স্ত্রীর হাতে দেয় নি। মানব-রচিত আইন! ভুল তো থাকবেই। আর, তাই, গ্রামে-গন্জে দেখা যায়, স্বামীর মৃত্যুর পর অনেক ক্ষেত্রেই বৃদ্ধা স্ত্রী যেন নবজীবন লাভ করে। কারণ, বিবাহিত/অবিবাহিত ছেলেমেয়েরা মাকে যেভাবে আদুরে করে রাখে, পিতাকে সেরকম করে না বা করতে পারে না। এজন্য শর্তসাপেক্ষে পিতার সঙ্গীনির প্রয়োজন, এবং এ প্রয়োজন বিভিন্ন বা একাধিক মনুষ-গত কারণে, শধুই মানবিক কারণে নয়।
তবে মুশকিল তো অন্য জায়গায়। এখন কেউ যদি যুক্তি দাঁড় করান, ১৫০০ বছর পূর্বের পুরনো আইনে আধুনিক যুগ চলবে কি করে, তাহলে উনাকে মানতেই হবেঃ প্রাগৈতিহাসিক কালের পুরনো সূর্যালোক, রাতের আঁধার, আগুন, মাটি, বাতাস আর পানি দিয়ে যেভাবে আধুনিক যুগ চলছে, ঠিক ঐভাবেই ১৫০০ বছর আগের আইনেও আধুনিক যুগও চলবে, এবং চলবে কিয়ামত পর্যন্ত। আবার কেউ যদি যুক্তি দেন, পুরুষ ৪ নারী রাখতে পারলে, নারী ৪ স্বামী রাখতে পারবে না কেন? উত্তর খুব সহজঃ কোন নারী যদি এক সাথে ৪ স্বামী রাখতে চান, সামাজিকভাবে ঐ নারীকে তার ইচ্ছা পুরনে সহযোগিতা করা উচিৎ, দেখা যাবে ৫ জন মানুষের মধ্যে ৫ রাতের ভিতরেই রক্ত-গঙ্গা বইছে। আর তা না হলেও, কন্যা জন্ম নিলে প্রত্যেক স্বামী বলবে, আমি তার বাপ না। অপরদিকে পুত্র জন্ম নিলে ৪ পুরুষই বলবে, “এ সন্তানের পিতা আমি”। অধিকন্তু, ঐ মা কি পারবেন তখন পিতা চিহ্নিত করতে? উপরন্তু, ডিএনএ টেস্ট করাবেন কয়জনের? পৃথিবীতে যে এখন ৭০০ কোটি মানুষ! আর আগামি শত বর্ষ পরে হবে কত কোটি?
আমি পড়েছি ইংরেজি সাহিত্য। এ সাহিত্যের গবেষণাই আমাকে শিখিয়েছেঃ “পোলিগ্যামি ইজ ফার ফার বেটার দ্যান প্রস্টিটিউশন”-অর্থাৎ, পতিতাবৃত্তি, বেহায়াপন, অীশ্ললতা, ব্যভিচার – ইত্যাদির চাইতে বহুবিবাহ শতগুণে উত্তম”। আর, প্রস্টিটিউটদের মধ্যে নারীও আছে, পুরুষও আছে সমানভাবে। বহুবিবাহ-ই এগুলোর একমাত্র সমাধান। আরো গভীরভাবে চিন্তা করলে দেখা যাবে, একজন নারী মাসের ২৯/৩০ দিনের মধ্যে ৪/৫/৭ দিন তার নারীত্ব-স্ত্রীত্ব-মাতৃত্ব-অবস্থা নিয়ে ভোগেন। আবার, সন্তান স্বাভাবিকভাবে জন্ম নিলে নাই ৪০ দিন, আর, কাট-পিস (সিজার) হলে চিকিৎসকের নিষেধ ৬ মাস। হতভাগা স্বামী যাবে কোথায়? তাই তো এত আত্মহনন শিক্ষিত বড়দের মধ্যেও। এর অবসান/একটা সুরাহা অবশ্যই প্রয়োজন।
অপর দিকে, যুব সমাজের কথা বলতে গেলে বলতে হয় শিক্ষার্থীদের কথা, বিশেষ করে বিশ্ববিদ্যালয়ে-কলেজে পড়ুয়া বড়রা। তারা চাকরি পায় না। পত্রিকায় গরম খবর ছাপা হল এ রকমঃ ৫ হাজার ২০০ শিক্ষক নিয়োগ দেয়া হচ্ছে। কিন্তু বেকার যে ৫০ হাজার রয়ে যাবে, তার উল্লেখ নেই। একটি সরকারি হাই-স্কুলে এক অনুষ্ঠানে গিয়েছিলাম। প্রধান শিক্ষক সাহেব বললেনঃ স্যার, পদ আছে ২৭ টি, শিক্ষক আছেন ৯ জন। বিভিন্ন স্কুল-কলেজের বেহাল দশার চিত্র প্রায়ই পত্রিকায় ছাপা হয়। দু’/তিন বছর পূর্বে গিয়েছিলাম পাসপোর্ট অফিসে। এতদিন লাগে কেন জানতে চাইলে আফিস-প্রধান বললেনঃ “স্যার, সারা দেশে জনবল লাগে ৫০ হাজার, পদ খালি ৩৫ হাজার, গোটা দেশে আমরা কর্তব্যরত আছি মাত্র এগারো হাজার, কি আর বলব স্যার, রাতদিন কাজ করেও কুলাতে পারি না”? আমি আরেকবার এক উপজিলা সদরের হাসপাতালে গিয়েছিলাম। যা শুনলাম, বিভিন্ন পদমর্যাদার ৫ ভাগের ৪ ভাগই খালি পড়ে রয়েছে দীর্ঘদিন ধরে। ডাক্তারের পদ নাকি ৯ টি, কোন ডাক পড়লে, বা চাকুরি রক্ষার বিপদ ছাড়া সচরাচর উপস্থিত থাকেন ১/২/৩ জন। ডাক্তার/নার্সের কাজ প্রায়ই করেন এমএলএসএসগণ, অথবা, যারা অবসরে গেছেন, ডেকে আনা হয় তাদেরকে। আয়-রোজগার তাদেরও কম না।
দুখের বিষয়, আমাদের মাস্টার-ডিগ্রিওয়ালারা ভূমধ্যসাগরে ডুবে মরছে, অনেকে বিদেশের জেলে দিন গুনছে। বছর পাঁচ/ছয়েক আগেও বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে ছিল আড়াই/তিন বছরের সেশনজট। আবার, বিসিএস এর নামে ফেলের পাহাড়! অধিকন্তু, চাকরীর বয়স-সীমাও বেঁধে দেয়া রয়েছে। আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়গুলো সত্যিই যদি মানসম্পন্ন গ্রাজুয়েট তৈরী করতে না-ই পারে, তবে এ সাদা হস্তীগুলো পালা বাদ দেয়া হোক, বিশ্ববিদ্যালয়গুলো উঠিয়ে দেয়া হোক, আর অমরা সবাই মিলে তখন একসথে প্রতিবন্ধী হয়ে বসে থাকি! নতুবা লক্ষ লক্ষ গ্রাজুয়েট কেন রাস্তায় ঘুরবে? হতাশা-নিরাশা-লজ্জা; ফলাফল=আত্মহনন। অথচ, বিদেশি শিক্ষার্থীদের চাইতে আমাদের শিক্ষার্থীরা অনেক বেশি ব্রিলিয়্যেন্ট, অনেক বেশি মেধাবি – এটা অস্বীকার করার উপায় নাই।
এবার একটু নজর দেই দেশের সাবরেজিস্ট্রি অফিসগুলোর দিকে। এক সাব-রেজিস্ট্রার দিয়ে চালানো হয় ৩ টি উপজিলা! ১ দিন বা ২ দিন অফিস হয়, তা-ও আবার বিকেলে/রাতে, যাতে বেশি বেশি ঘুষ লওয়া যায় (তবে বদনাম তো শুধু পুলিশের)। গ্রাম-গন্জের জমি-বিক্রেতা নারী-পুরুষ-বৃদ্ধ-বৃদ্ধা এক দলিলের জন্য হয় তো বা এসেছেন ১৫ জন, ফিরতে হবে, বাড়ি হয়ত ১০/১২ মাইল দূরে, তদুপরি গ্রামের রাস্থা। এদের কষ্টের সীমা নেই। আবার, “আকিম সাহেব” থাকেন “টাউনে”, অফিসে পৌঁছতে পৌঁছতে বাজে ২.০০ টা। প্রত্যেক উপজিলায় একজন ইউএনঅ দিতে পারলে একজন করে সাব-রেজিস্ট্রার দিতে অসুবিধা কোথায়? তখন রেজিষ্ট্রি হত/অফিস চলত ৫ দিনই, ৯টা – ৫টা । হেঁ, যে সরকারই আসে, চাকুরি না দিয়ে শুধু টাকা বাঁচাও। ভুলি নাই, বিদ্যুতের জ্বালায় ’৯১/’৯২ সালের দিকে আমি ৩ টি ল্যান্টর্নও কিনেছিলাম। আর খালি গায়ে শুয়ে থাকতাম (ভাগ্যিস) পাকা মেঝেতে।
কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া ছেলে-মেয়েদের পরস্পরের সাথে/মধ্যে জানাশুনা, আন্ডার্স্টেন্ডিং থাকতেই পারে। দু’জন হয়ত একে অপরকে কথাই দিলঃ একটা চাকরি-বাকরি হয়ে যাক। চাকরি না হওয়ায় বিয়েতে দেরি হচ্ছে। কিছু না জেনে মা-বাবা হয়ত অন্যত্র মেয়ের বিয়ে ঠিক করলেন। সইতে না পেরে মেয়ে আত্মহননের পথ বেছে নিল, আর, ছেলে ওটা জানতে পেরে সে-ও ঐ পথেই এগুলো। যে কোন দেশে যে সরকারই থাকুক বা আসুক না কেন, সে যেমন উচ্চশিক্ষার ব্যবস্থা করে, ঠিক তেমনি তার উচিৎ একই সঙ্গে আনুপাতিক হারে উপযুক্ত কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করা। উচ্চশিক্ষিত বেকার সৃষ্টি করা কারো কাম্য হতে পারে না। অন্যতায়, উচ্চশিক্ষার দ্বার সংকোচিত করা হোক। তা হলে, অল্পশিক্ষিত হওয়ার কারণে যে যার যার পথ পূর্ব থেকেই বেছে নেবে। সেক্ষেত্রে, অন্তত যে কোন দেশের যে কোন সরকার সকল উচ্চশিক্ষিতদেরকে চাকুরি দেয়া থেকে, দায়মুক্ত থাকবে।
আর একটি কথাঃ আমাদের যে কোন পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকগণ বয়সের কোন এক পর্যায়ে দেশে-বিদেশে গবেষণা করে কোন না কোন উচ্চতর ডিগ্রি অর্জন করে নেন। ফলে, দেখা যায়, একেকটি বিভাগে এক সময় ৯৫% শিক্ষক হয়ে যান উচ্চতর ডিগ্রিধারি-গবেষক-শিক্ষক। এখন যে গ্রাম-গন্জের কলেজে অনার্স-মাস্টার্স খোলা হচ্ছে অবলীলায়, খোঁজ নিয়ে দেখুন, ওগুলোতে পড়াচ্ছেন কারা, মাসে ক্লাশ হয় কয়টা, শিক্ষার্থীরা মাসে কলেজে যায় কয়দিন? এদের প্রায় সকলেই কোন না কোন রোজগারের পথে আছে, যেহেতু ক্লাশের কোন বালাই নেই, আর পড়ছে প্রাইভেট। শহরের এক শিক্ষকের বাড়িতে একবার গিয়ে আমার চোখ তো ছানা-বড়া, দেখলাম, এটা তো বাসা নয়, যেন প্রায় শ’খানেক প্রাইভেট শিক্ষার্থী এক সাথে বসার এক স্কুল! আবার ঐ শিক্ষকের একজন সহকারিও আছেন! একবার ইংরেজির এক শিক্ষক এসেছিলেন আমার অফিসে। টেবিলে রাখা ছিল একটি ইংলিশ-ভার্সন আন্তর্জাতিক জার্নাল। উনি এক পর্যায়ে ওটা হাতে নিলেন। খুলতেই বেরিয়ে গেল একটি আর্টিকেল। শিরোনামের নিচেই লিখা ছিল ‘এ্যব্স্ট্রাক্ট’ শব্দটি। উনি আমাকে ওটা দেখিয়ে জিজ্ঞেস করলেন ঐ শব্দটির মানে কী? আমি তো রীতিমত এক আহ্মক বনে গেলাম! অবশ্য ব্যতিক্রম সকল জায়গায়ই আছে। তবে, মনে পড়ছে অধ্যাপক ড. জাফর ইকবালের কথা, উনি একাডেমিক কাউন্সিলের একটি সভায় বলেছিলেনঃ “উচ্চতর কোন ডিগ্রি ছাড়া (অর্থাৎ গবেষণা-কর্ম করা ছাড়া) অনার্স-মান্টর্সে পড়াতে যাওয়া কারোর পক্ষেই উচিৎ নয়”। তাই তো বিসিএস এর-ও এই হাল। আর চাকুরি না দেয়ার দায়-ভার শুধু শুধুই যাচ্ছে চলমান সরকারের উপর।
বড়দের কেত্রে স্বামী-স্ত্রীর পারস্পারিক সম্পর্ক, বা অন্য কিছু, অন্যান্য ফ্যাক্টার্স / বিষায়াবলীর / ঘটনাপ্রবাহের কারণ হতে পারে, কিন্তু চাকরী না পাওয়ার হতাশা, নিরাশা, অনিশ্চয়তা, গ্লানি, লজ্জা, পরিবারকে কিছু দিতে না পারার দুঃখ-বেদনা, কাঙ্খিত বিয়েতে বিফল হওয়া ইত্যদি-ই উদ্যমি-ইয়াং উচ্চ-শিক্ষিতদের মধ্যে অধিক আত্মহননের গুড় রহস্য। আর, এর সমূহ-ই হচ্ছে আমার দীর্ঘ গবেষণা এবং দীর্ঘ শিক্ষকতার নিউ ফাইন্ডিংস্ বা নতুন আবিষ্কার।
লেখক: প্রফেসর ড. মো. আতী উল্লাহ (বিসিএস, পিএইচডি-ইংলিশ), প্রতিষ্ঠাকালীন ও সাবেক ২৪ বছরের বিভাগীয় প্রধান, ইংরেজি বিভাগ, শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, সিলেট এবং দেশে-বিদেশে ৪৬ বছরের ইংরেজি সাহিত্য ও ইংরেজি ভাষার শিক্ষক।