নিপাহ ভাইরাসের কয়েকটি ছবি, সৌজন্যে-ইন্টারনেট

‘নিপ’ শব্দটি একটি ইংরেজি শব্দ। দ্য অক্সফোর্ড পকেট ডিক্সনারি অব কারেন্ট ইংলিশ এ শব্দটির অর্থ করেছে এভাবেঃ চোখা কোনকিছু দিয়ে জোরে খোঁচা দেয়া, দুই-চার বা ততধিক বিপরীত দিক থেকে সজোরে চাপ দেয়া, যেমন আমরা চাপ দেই একটি টুথ-পেষ্ট টিউবকে বা স্পঞ্জের টুকরাকে, বা একটি কাঁকড়া যেমন তার সকল হাত-পা দিয়ে কোন খাবারকে সকল দিক থেকে চিমটে ধরে, চিল বা বাজ-পাখি যেমন অকস্মৎই মুরগীর বাচ্চা বা অন্য খাবার ঝাপটা মেরে ধরে উড়াল দেয়। এক কথায়, ‘নিপ’ এর অর্থ চঙ্গল বা চঙ্গল মারা, যাতে ধৃত বস্তু কোন অবস্থায় বেরুতে বা পড়ে যেতে না পারে। আর, এই ‘নিপ’ থেকেই ‘নিপাহ’ শব্দের উৎপত্তি।
 

অক্সফোর্ড এডভান্সড লারনার্স ডিক্সনারি ‘নিপ’ এর অর্থ করেছেঃ মানুষের হাতের বুড়ো আঙ্গুল এবং পাশের শাহাদত আঙ্গুল দিয়ে কোনকিছু চিমটি মেরে ধরা বা সজোরে চাপ দেয়া, দাঁতের দুই পাটি দিয়ে কোনকিছুতে কামড় দেয়া, যেমন করে কাঁকড়া তার শিকারকে চঙ্গল মেরে বা খোঁচা মেরে চতুর্দিক থেকে ধরে, বা দরজা এবং দরজার চৌকাটের মধ্যখানে দুর্ঘটনাবশতঃ মানুষের আঙ্গুল যদি পড়ে যায়, উহ্, কী দুঃখ! এখন একটিবার আমরা চিন্তা করি, ‘নিপ’ এর অর্থ কতই না ভয়াবহ, আর নিপাহ ভাইরাস কতই না ভয়ঙ্কর ভাইরাস হতে পারে? 
আর ইংরেজি ‘ভিরুল্যান্ট’ শব্দটি এসেছে ল্যাটিন ভাষার শব্দ ‘ভাইরাস’ থেকে। অবশ্য ল্যাটিন ‘ভাইরাস’-ই উঠে এসেছে ইংরেজি ‘ভাইরাস’ হিসেবে। ‘ভিরুল্যান্ট’ শব্দের অর্থ হলো ‘পয়জনাস’, অর্থাৎ শক্তিশালি বিষ (পয়জন) বা বিষাক্ত পদার্থ। ল্যাটিন ‘ভাইরাস’ শব্দটির অর্থও ‘বিষ’।
 
এখন, হে অসহায় মানব! একটিবার চিন্তা করো, কোন্ ভাইরাসের মোকাবেলা তোমরা করবে? “লাঠি আনতে আনতে কিলে শেষ” অবস্থা মানুষের, কারণ, এতদিন থেকেও মানুষ নিপাহ ভাইরাসের প্রকৃতপক্ষে কার্যকরি কোন প্রতিষেধক বের করতে পারে নি।
 


নিপাহ ভাইরাসের সংক্ষিপ্ত ইংরেজি নাম হচ্ছে ‘নিভ’ (নিপা ভাইরাস,  বানান হচ্ছেঃ বড় হাতের ‘এন’, ছোট হাতের ‘আই’ এবং বড় হাতের ‘ভী’)। এ ভাইরাসের আক্রমন খুবই দ্রুত বিস্তার লাভ করে। ‘নিপাহ ভাইরাস ইনফেক্শন’ অর্থ হচ্ছে = এ বিষাক্ত ভাইরাসের দ্বারা বিস্তারকারি ক্ষত। এর বিস্তার খুবই ভয়ংকর। মোদ্দা কথা, এটি একটি ভয়ানক সংক্রামক ব্যধি।

গবেষক ও বিশেষজ্ঞদের মতে, এ ঘাতক-রোগের কিছু কিছু লক্ষণ হচ্ছেঃ জর, কাশি, মাথাব্যথা, মাংসপেশির ব্যথা, বমি বমি ভাব, গলায় ক্ষত, ঘুম ঘুম ভাব, মনের অসচেতনতা, নিউমোনিয়া, প্রচন্ড শ্বাসকষ্ট, ডায়রিয়া, এবং দিক-বিদিক জ্ঞানশূন্য হওয়া। ১/২ দিনের মধ্যেই এর সংক্রমন রোগীকে মুমুর্ষূ করে তুলতে পারে এবং ৫০% থেকে ৭৫% রোগী মৃত্যুবরন করতে পারে।

রোগটির জটিলতার মধ্যে আরও রয়েছেঃ সুস্থ হয়ে গেলেও রোগীর মগজ ফুলে যেতে পারে; ব্রেনের শিরা-উপশিরার ক্ষতি হয়ে মৃগি রোগ পর্যন্ত হতে পারে।

এমনও দেখা গেছে, সংক্রমনের লক্ষণ প্রকাশ পেতে ৪ থেকে ১৪ দিন পর্যন্ত গড়িয়েছে। আবার, ক্ষেত্রবিশেষে ৪৫ দিন পরেও লক্ষণ প্রকাশ পেয়েছে।
 

নিপাহ ভাইরাস ইনফেকশনের মৌল কারণ/বাহক হচ্ছে, বাদুড় এবং শুকর। যে ফল বাদুড় বা শুকর খেয়েছে, তার অংশবিশেষ মানুষ যদি খায়, বা কোন ভাবে তার সংস্পর্শে আসে, তবে সে এ বিষাক্ত ক্ষত দ্বারা আক্রান্ত হতে পারে। শুকর এবং ফল খাওয়া বাদুড় মানব দেহের জন্য ভয়ংকর। শুকর বা অন্য পশু থেকেও মানুষের মধ্যে এ রোগের সংক্রমন হতে পারে। তারপর মানুষ থেকে মানুষে এ রোগ ছড়িয়ে পড়তে পারে। শুকর স্বয়ংও এ ভাইরাসে আক্রান্ত হয় অধিক। আর, তারপর শুকর লালন-পালনকারি মানুষ। আর তাই শুকরের খামারিরা প্রায়ই চরম অর্থনৈতিক মন্দার কবলে পড়ে।

নিপাহ ভাইরাস সর্বপ্রথম ধরা পড়ে ১৯৯৯ খ্রীষ্টাব্দে মালয়েশিয়ায়। ঐ বছরই মালয়েশিয়ার শুকর খামারিরা এ ভাইরাসে আক্রান্ত হয়। তখন লক্ষ্য করা গিয়েছিল, মালয়েশিয়ার যে সমস্থ লোকজন অসুস্থ শুকরের সংস্পর্শে এসেছিল, তারাই সরাসরি আক্রান্ত হয়েছিল।

মালয়েশিয়ার এই নিপাহ ঢেউ সিঙ্গাপুরেও হানা দেয়। এর পর অবশ্য সে সমস্থ দেশে আর নিপাহ ভাইরাসের প্রাদুর্ভব ঘটে নি।

বাংলাদেশে এ ভাইরাস প্রথম ধরা পড়ে ২০০১ সালে। তৎপরবর্তীতে প্রায়-বছরই আমাদের দেশে এর পূনরাবৃত্তি ঘটে আসছে। ভারতের পূর্বা লেও সময়ে সময়ে এ ভাইরাস হানা দেয়। অন্যান্য দেশ যেমন কম্বোডিয়া, ঘানা, ইন্দোনেশিয়া, মাদাগাস্কার, ফিলিপাইন দ্বীপপূঞ্জ এবং থাইল্যান্ডেও এ রোগের প্রাদুর্ভাব ঘটেছে। সময়ে সময়ে দেখা গেছে, বাংলাদেশ ও ভারতে যে সমস্ত তাল গাছ ও খেজুর গাছ বাদুর ছুঁয়েছিল, সেগুলোর রসের মাধ্যমেই দেশ দু’টিতে এ ভাইরাসের সংক্রমন ঘটেছিল। কারণ, গাছগুলো যে ভাবেই হোক, বাদুরের মলমূত্র, তার গায়ের দুর্গন্ধ এবং লালার সংমিশ্রনের আসে। সুতরাং বাদুর যে রোগটির একটি মৌলিক কারণ, তা সন্দেহাতীত। মানুষ থেকে মানুষে সংক্রমন পরিবারের মধ্যেই অধিক হয়। আরও সংক্রমিত হয় তারা, যারা ঐ সমস্থ রোগীদেরকে সেবা দেয়।
 

এ রোগ নির্ণয় সাধারণতঃ ও মূলতঃ লক্ষণ-ভিত্তিক, যার নিশ্চয়তা দিতে পারে একমাত্র ল্যাবোরেটোরি-পরীক্ষা। ২০২১ সাল পর্যন্ত রোগটির কোন প্রতিষেধক বিজ্ঞানীদের পক্ষে আবিষ্কার করা সম্ভব হয় নি। এ থেকে বেঁচে থাকার সর্বোত্তম উপায় হল বাদুর ও রোগাক্রান্ত শুকরের সংস্পর্শে না আসা। অন্য উপায় হল, তাল গাছ-খেজুর গাছের রস পান না করা, যদিও এগুলো এ অলসমূহে, বিশেষ করে শীত মৌসুমে, অমৃত পানীয় হিসেবে গণ্য হয়।

২০১৮ সালের মে মাস পর্যন্ত এ অ লসমূহে ৭০০ জন আক্রান্ত রোগীর সন্ধান মেলে এবং এর ৫০ থেকে ৭৫ শতাংশ রোগী মারাই যায়। ঐ একই সময়ে ভারতের কেরালা রাজ্যে এ রোগের প্রাদুর্ভাব ঘটে এবং মারা যায় ১৭ জন।

মালয়েশিয়া-ভিত্তিক এ রোগটির ইতিহাস ঘাটলে আরও প্রতীয়মান হয় যে, দেশটির মালয়া বিশ^বিদ্যালয়ের মেডিসিন অনুচ্ছেদের একদল গবেষক ১৯৯৮ সালেই রোগটি নির্ণয় করতে সক্ষম হন। আক্রান্ত ব্যক্তিদের অধিকাংশকেই একই বিশ্ববিদ্যালয়ের মেডিসিন সেন্টারে চিকিৎসা সেবা প্রদান করা হয়। অপরপক্ষে, মালয়েশিয়ার একটি গ্রামে সর্বপ্রথম এ রোগটি ধরা পড়ায় সে দেশের ঐ গ্রামের নামানুসারেই ভাইরাসটির নামকরন হয়ে যায় ‘নিপাহ’, কারণ, গ্রামটির নাম হচ্ছেঃ ‘সুংগাই নিপাহ’। যেহেতু সেদেশে তখন শুকরই প্রথম আক্রান্ত হয়েছিল, তাই মালয়েশিয়ান কর্তৃপক্ষ ১৯৯৯ সালেই মিলিয়ন মিলিয়ন শুকর হত্যা  করেছিল রোগটির বৃহত্তর সংক্রমন রোধ করতে এবং তাদের ঐ পদক্ষেপ বাস্তবেও সফলতা লাভ করেছিল।
 

যাক, কাকতালীয়ভাবে নিপাহ গ্রামটির নাম ইতিহাসে এক হয়ে রয়েছে ‘নিপাহ ভাইরাস’ এবং ইরেজি শব্দ ‘নিপ’ এর সাথে। হায়রে লেখা-পড়া, হায়রে জ্ঞান-পিপাসা, তোমরা কতই না মজার!

লেখক: ইংরেজি বিভাগের প্রতিষ্ঠাতা ও ২৪ বছরের বিভাগীয় প্রধান, বিভাগের সাবেক জ্যেষ্ঠতম অধ্যাপক, শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, সিলেট, ও দেশে-বিদেশে ৪৬ বছরের ইংরেজি ভাষা ও ইংরেজি সাহিত্যের শিক্ষক।