হবিগঞ্জের আজমিরীগঞ্জ পৌর এলাকাসহ আশপাশের এলাকাগুলোতে চলছে শিলং তীর নামক জুয়া। যে জুয়া খেলেই ইতোমধ্যে সর্বশান্ত হয়ে গেছে অনেক পরিবার। ঘর ছাড়া হয়েছে অনেক তরুণরা। অভিযোগ রয়েছে খোদ আজমিরীগঞ্জ থানা পুলিশকে ম্যানেজ করেই জুয়ার এমন কর্মকান্ড চলছে। দিনে রাতে প্রকাশ্যে এজেন্ট নিয়োগ করে শিলং তীর জুয়া খেলা হলেও এ বিষয়ে কোন তথ্যই নেই থানা পুলিশের কাছে। পুলিশ বলছে, এক সময় এই জুয়া খেলা থাকলেও এখন আর নেই। এদিকে, অনলাইন ভিত্তিক সর্বনাশী এই জুয়া খেলা প্রতিরোধে পুলিশকে কার্যকরি ভূমিকা নেয়ার আহব্বান সচেতন মহলের।


খোঁজ নিয়ে জানা যায়, আজমিরীগঞ্জ বাজারের ধান-চাল ব্যবসায়ী নাসিম মিয়া। পৌর সদর বাজারে ছিলো তার ব্যবসা প্রতিষ্টান। তার অধীনে ১০/১২ জন শ্রমিক প্রতিদিন কাজ করতো। তার ব্যবসায় আয় উন্নতি ছিল ভালোই। হঠাৎ সঙ্গদোষে অনলাইন ভিত্তিক শীলং তীর নামক জুয়ায় জড়িয়ে দিনেদিনে নিঃস্ব হয়ে প্রায় অর্ধকোটি টাকার দেনানিয়ে ভিটেবাড়ি বিক্রি করে পরিবার পরিজন নিয়ে রাতের আধাঁরে চট্রগ্রামে উদ্দেশ্যে পাড়ি জমান তিনি। বর্তমানে তিনি একটি ফ্যাক্টরিতে শ্রমিকের কাজ করে পরিবার পরিজন নিয়ে জীবিকা নির্বাহ করে আসছেন। শুধু নাসিম মিয়াই নয়, ‘শিলং তীর’ খেলার ফাঁদে পরে নিঃস্ব হয়েছেন শত শত পরিবার। হাওরের জমিজমা বিক্রি করে এখন তারা নিঃস্ব। আর রাতের আধাঁরে এলাকা ছেড়েছেন আরো অনেকেই।



অনুসন্ধানে জানা যায়, ‘তীর’ খেলা মূলত ভারতের শিলং থেকে পরিচালিত হয়। সেখানকার ক্লাবের মধ্যসত্ব ভোগীরা বাংলাদেশে এজেন্ট নিয়োগ দেয়। বাংলাদেশী এজেন্টরা আবার বিভিন্ন এলাকায় তাদের সেলসম্যান নিয়োগ করেন। এই সেলসম্যানদের মাধ্যমে সাধারণ মানুষকে বিভিন্ন ধরনের লোভ দিয়ে শিলং তীরে আসক্ত করেন। এ খেলার জন্য ভারতের শিলংভিত্তিক ওয়েবসাইট থেকে প্রাপ্ত ১ থেকে ৯৯ পর্যন্ত নম্বরগুলো বিক্রি করা হয়ে থাকে। এই নম্বরগুলো যারা কেনেন তাদের সাথে সেলসম্যানরা (স্থানীয় ভাষায় মুহরী) যোগাযোগ করেন। তখন জুয়াড়িরা সেলসম্যানের কাছে নম্বর ও বিভিন্ন অঙ্কের টাকা দেয়। সেলসম্যানরা বিক্রিত এই নম্বরের বিপরীতে টাকা এজেন্টের কাছে দেয়।


ভারতের শিলংয়ে শনিবার ও রোববার ব্যতীত সপ্তাহের পাঁচদিন বিকেলে এই জুয়া খেলার প্রথম রাউন্ড ও দ্বিতীয় রাউন্ড নামে দুটি ড্র অনুষ্ঠিত হয়। এতে ১ থেকে ৯৯ এর মধ্যে একটি নম্বর বিজয়ী হয়। যারা ওই নম্বরটি ক্রয় করে তারা বিজয়ী হিসেবে গণ্য হয় এবং বিজয়ীরা নম্বরের ক্রয়মূল্যের ৭০ গুণ টাকা এজেন্টের মাধ্যমে পেয়ে থাকেন। কিন্তু বেশির ভাগ জুয়াড়ি বিজয়ী হতে না পেরে তাদের পুঁজি হারিয়ে ফেলে।


সিলেটের সীমান্তবর্তী ভারতের শিলং ও গৌহাটি এলাকা থেকে ১৯৯০ সাল চালু হয় ‘শিলং তীর’ নামের এই জুয়ার। পরবর্তীতে অনলাইনের মাধ্যমে এটি সিলেটে বিস্তার লাভ করে। ২০১৪ সালে আজমিরীগঞ্জ উপজেলার জলসুখা গ্রামের কিছু যুবক সিলেটের জাফলং পাথর খোয়ারিতে কাজে যান। সেখান থেকেই তারা এই খেলা রপ্ত করেন। পরবর্তীতে এই যুবকদের হাত ধরেই আজমিরীগঞ্জের সর্বত্র ‘শিলং তীর’ জুয়া ছড়িয়ে পরে। পাতানো এই খেলায় একদিকে যেমন নিঃস্ব হচ্ছেন সাধারণ মানুষ, অন্যদিকে জুয়াড়িদের কাছ থেকে হাতিয়ে নেয়া টাকা হুন্ডির মাধ্যমে চলে যাচ্ছে ভারতে। করোনাকালীন সময়ে কিছুদিন বন্ধ থাকলেও বিগত বছরখানেক যাবত তা ভয়াবহ রুপ ধারন করেছে। বর্তমানে পৌর এলাকার মুন সিনেমা হলের সামনে কয়েকটি চায়ের দোকান, একই রোডের কাপরের দোখান, টানবাজারের কয়েকটি ব্যবসা প্রতিষ্টা ,কাকাইলছেও রোডে কাট পট্রি ও থানা সংলগ্ন কয়েটি গ্রামে গ্রামে এ জুয়া বেশি হচ্ছে বলে জানা গেছে।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে এই খেলায় জড়িত এক যুবক জানান, বিগত বেশ কয়েক মাস ধরে আজমিরীগঞ্জের বিভিন্ন এলাকায় সক্রিয় হয়ে উঠেছে কয়েকটি সিন্ডিকেট চক্র। তারা পুরনো জুয়াড়িদের পাশাপাশি নতুন যুবকদেরর শিলং তীর খেলায় উদ্বুদ্ধ করছে। এমনকি উপজেলার অনেক নারীও এই জুয়ায় আশক্ত রয়েছেন। তিনি জানান, আজমিরীগঞ্জ পৌরসভায় ৫টি সিন্ডিকেটের মাধ্যমে অন্তত ৪০ জন সেল্সম্যান সক্রিয় রয়েছে।


নাম প্রকাশ্যে অনিচ্ছুক এক জুয়াড়ি জানান, আমাদের প্রতিটি গ্রুপের সদস্যদেরই থানায় মাসোহারা দিতে হয়। কেউ ১০ হাজার আবার কেউবা ৩ হাজার টাকা করে দেয়। মূলত পুলিশকে ম্যানেজ করেই তারা এ কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছে। যদিও বিষয়টি সম্পর্কে একমত নন আজমিরীগঞ্জ থানার (ওসি) মো. মাসুক আলী।


তিনি জানান, শিলং তীর জুয়ার বিষয়ে আমাদের কাছে সঠিক কোন তথ্য নেই। এছাড়াও পুলিশকে ম্যানেজ করার বিষয়টি ভূয়া। আমরা যখনই কোন ধরণের জুয়া বা মাদকের খবর পাই আমরা অভিযান চালাই। তিনি বলেন, একসময় শিলং জুয়া ছিল এখন নেই। ওসি আরো বলেন, স্বার্থ হাসিল না হলে অনেকেই পুলিশের বিরুদ্ধে অভিযোগ দেয়।


সিলেটভিউ২৪ডটকম/জাকারিয়া/ইআ-১২