আহবাব চৌধুরী খোকন এ সময়ের পরিচিত লেখকদের একজন। যারা নিয়মিত পত্রিকার পাঠ গ্রহণ করেন, বিশেষ করে আমেরিকায় বাংলাদেশী জনগণের অধ্যূষিত নিউইয়র্ক স্টেইটে প্রতি সপ্তাহে অসংখ্য বাংলাপত্রিকা প্রকাশিত হয় এবং এসব প্রকাশিত বাংলা পত্রিকার কোনো না কোনো পত্রিকায় তাঁর লেখা প্রবন্ধ/নিবন্ধ প্রতি সপ্তাহে প্রকাশিত হচ্ছে। ফলে তাঁর লেখা থেকে পাঠকরা সমসাময়িক বিষয়াবলী সম্পর্কে অবগত হতে পারছেন। মূলত কলাম ও প্রাবন্ধিক লেখক আহবাব চৌধুরী খোকন ছাত্রাবস্থা থেকে সাংবাদিকতার সাথে যুক্ত হোন এবং প্রতিনিয়ত নানা বিষয় নিয়ে লেখালেখি করে সুধীমহলের প্রশংসা অর্জন করে যাচ্ছেন। সেই ধারাবাহিকতায় তিনি সামাজিক, রাজনৈতিক এবং সাংসারিক শত ব্যস্ততার মাঝেও সংবাদপত্রে প্রতিনিয়ত বাংলাদেশ, আমেরিকাসহ পৃথিবীর নানাপ্রান্তে ঘটে যাওয়া নানা বিষয় নিয়ে লিখছেন এবং লেখালেখির মাধ্যমে বয়োবৃদ্ধ থেকে শুরু করে আজকের তরুণদের সুন্দর দেশ ও সমাজ গঠনে অনুপ্রাণিত করার চেষ্টা করে  যাচ্ছেন। 

ইতিপূর্বে তাঁর দুটি বই যথাক্রমে কালের ভাবনা ও জিরোপয়েন্ট প্রকাশিত হয়েছে। কালের ভাবনা পাঠ করে উপলব্দি করেছি, তিনি তাঁর সময়কে নানা ব্যঞ্জনায় নানা মাত্রায় শব্দের নান্দনিকতায় আমাদের সামনে তুলে এনেছেন। অন্যদিকে জিরোপয়েন্ট তাঁর ভ্রমণ বৃত্তান্তের একটি দৃষ্টি নন্দন বই। এই বইটিও বিজ্ঞ পাঠক মহলের প্রশংসা কুড়িয়েছে। মূলত এই দুটি বই প্রকাশিত হবার পর, তাঁর লেখক সত্ত¡া বা প্রতিভা সবার দৃষ্টি আকর্ষণ করে।



কালের ভাবনা বইটির পান্ডুলিপি পাঠ করে জাতীয় পত্রিকা মানবজমিন সম্পাদক, দেশের বিশিষ্ট সাংবাদিক মতিউর রহমান চৌধুরী বলেছেন, ‘সমাজ চেতনা, রাজনীতি, সাংবাদিকতার দুনিয়ায় একবার প্রবেশ করলে আর যেন বের হওয়া যায় না। অনাবাসী বাংলাদেশি আহবাব চৌধুরী খোকনের বেলাতেও এ-কথাটি সত্য। দীর্ঘদিন ধরে নিউইয়র্কে বসবাস করছেন তিনি। সেখানেও নিজেকে জড়িয়ে রেখেছেন নানা সামাজিক ও সৃষ্টিশীল কর্মকাÐে যার প্রমাণ কালের ভাবনা। শেকড়ের সঙ্গে সম্পর্ক যেন ছিন্ন না হয় তা আমরা সবসময় অনুভব করি। এক্ষেত্রে বাংলা চর্চার গুরুত্ব অপরিসীম। কালের ভাবনা এ কারণেও গুরুত্বপূর্ণ। আহবাব হোসেন খোকনের বয়ানে উঠে এসেছে দেশ ও দেশের মানুষের কথা। লেখাগুলো পাঠ করলে একজন দেশ প্রেমিক মানুষ হিসেবে চিত্রিত হয়ে ওঠেন।’

 

দেশের জনপ্রিয় ও সিনিয়র একজন সাংবাদিক যখন এমন মন্তব্য করেন তখন আমরা তাঁর দেশ প্রেম ও লেখালেখি নিয়ে আশাবাদী হয়ে উঠি। এবং পরের বই জিরোপয়েন্ট নিয়ে অসংখ্য বিজ্ঞজনদের মতামত বা আলোকপাত তাঁকে আরেক ধাপ উচ্চতায় এগিয়ে নিয়ে যায়। আমরা আরো বেশি আশাবাদী হয়ে উঠি এবং সর্বশেষ তাঁর এই ‘মুক্ত মনের ভাবনা’ বইটি পাঠ করলে সহজেই অনুমান করে নেয়া যায় যে, তিনি এই সময়ের একজন গুরুত্বপূর্ণ লেখক। এই বইয়ের সুচিবদ্ধ লেখাগুলো পাঠ করলে মনে হয় যেন এই ভাবনাগুলো শুধু লেখকের নয়, আমাদেরও। অর্থ্যাৎ দুই মলাটে বন্দী বইটির লেখাগুলো পাঠকের মনকেও দোলা দিবে বলে আমি মনে করি। এখানে বইটির অর্ন্তভ’ক্ত বা সুচিবদ্ধ লেখাগুলো উল্লেখ করা হলো; মাকে আমার মনে পড়ে (পৃষ্টা-১১), নারীরা বৈষম্যের হাত থেকে মুক্তিপাক (পৃষ্টা-১৫), প্রতিফলিত হোক কুরবাণির শিক্ষা (পৃষ্টা-১৮), শাবিতে ছাত্র অসন্তোষ এবং সরকারের করণীয়(পৃষ্টা-২১), চারটি অপমৃত্যু ও অপ্রিয় কিছু কথা (পৃষ্টা-২৫), এম সি কলেজে অনৈতিক কর্মকান্ড আর কত? (পৃষ্টা-২৯), হাতি ঘোড়া গেল তল, মশা বলে কত জল (পৃষ্টা-৩২), সাম্য ও মানবতার কবি নজরুল (পৃষ্টা-৩৫), অকাল মৃত্যু দেখতে চাই না (পৃষ্টা-৩৯), মূলধারার জাগানো প্রত্যাশার জয় হোক (পৃষ্টা-৪৩), নিউ ইয়র্কের ব্রæঙ্কস এখন বাংলাদেশিদের স্বর্গসুখের আবাসস্থল (পৃষ্টা-৪৬), মা-বাবার প্রতি সন্তানের কর্তব্য (পৃষ্টা-৫১), বাংলাদেশ স্পোর্টস কাউন্সিল একটি অনন্য সংগঠন (পৃষ্টা-৫৫), একটি চিঠি যখন হয়ে উঠে স্মরণীয় কবিতা (পৃষ্টা-৫৭), করোনাক্রান্ত নিউ ইয়র্ক ও অসুস্থ পৃথিবী (পৃষ্টা-৬১), প্রবাসীদের হয়রানী বন্ধ কবে হবে (পৃষ্টা-৬৪), পাইয়া পরের ধন বাপে পুতে কীর্তন (পৃষ্টা-৬৭), কারো পৌষমাস কারো সর্বনাশ (পৃষ্টা-৭০), সৌদি আরবে মহিলাকর্মী পাঠানো বন্ধ হোক (পৃষ্টা-৭৩), সবুজ বনায়ন ও একজন আফতাব চৌধুরী (পৃষ্টা-৭৬), স্মৃতিময় ফেঞ্চুগঞ্জ (পৃষ্টা-৭৯), মাদকমুক্ত সমাজ গঠনে চাই পারিবারিক সচেতনতা (পৃষ্টা-৮৩), সময় বয়ে যায় (পৃষ্টা-৮৭), ঢেকি স্বর্গে গেলেও ধান ভানে (পৃষ্টা-৯০), মসজিদ কমিটি ও প্রাসঙ্গিক কিছু কথা (পৃষ্টা-৯৩), জনপ্রিয়তার শীর্ষে ঠিকানা (পৃষ্টা-৯৭), দেশ হোক সকলের (পৃষ্টা-১০০), নবযুগ এগিয়ে যাক (পৃষ্টা-১০৪), বর্ণ বৈষম্য ও ক্ষোভের আগুনে পুড়ছে যুক্তরাষ্ট (পৃষ্টা-১০৭), প্রবাসীদের ভোটাধিকার কত দূরে (পৃষ্টা-১১০), মুক্ত ফিলিস্তিন এখন সময়ের দাবি (পৃষ্টা-১১৩), রোহিঙ্গরা বাংলাদেশের সমষ্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে (পৃষ্টা-১১৭)।

 

মুক্ত ভাবনা বইটির সূচিপত্রের দিকে নজর বুলালে সহজেই অনুমান করে নেওয়া যায় যে এই বইটির প্রবন্ধ/নিবন্ধগুলো সমসাময়িক বিষয় নিয়ে লেখা হয়েছে। আমার জানামতে এই লেখাগুলো নিউ ইয়র্কসহ ঢাকার জাতীয় পত্রিকাগুলোতে বিভিন্ন সময় ছাপা হয়েছে। সুচিপত্রের শিরোনামগুলো পাঠ করলে পাঠকমাত্রই বুঝে নিতে পারেন যে, লেখাগুলোর গুরুত্ব বা ওজন কতখানি। পাঠকের সুবিধার্থে দুটি লেখার অংশ বিশেষ এখানে উল্লেখ করছি-


যুক্তরাষ্ট্রে কৃẲাঙ্গ জনগোষ্টির আগমন শুরু হয়েছিল দাসত্ব প্রথার সময়ে। ষোড়শ শতক থেকে শুরু হওয়া এই দাস প্রথা উনবিংশ শতকের মাঝামাঝি পর্যন্ত চালু ছিল। জানা যায়, এই সময়ে আফ্রিকাসহ বিভিন্ন দেশ থেকে প্রায় দুই কোটি নারী-পূরুষ, শিশু দাস হিসেবে এসেছিল এই যুক্তরাষ্ট্রে। ১৭৮৩ সালে যুক্তরাষ্ট্র স্বাধীনতা পেলেও কৃẲাঙ্গ সম্প্রদায় মুক্তি পায়নি দাস প্রথা থেকে। ১৮৬১ সালে আব্রাহাম লিঙ্কন প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হলে ১৮৬৩ সালে তিনি আনুষ্ঠানিকভাবে দাসপ্রথা বাতিল ঘোষণা করেন। দাসপ্রথার বিরুদ্ধে অবস্থান নেওয়ায় ১৮৬৫ সালে গুলি করে হত্যা করা হয় প্রেসিডেন্ট আব্রাহাম লিঙ্কনকে। আব্রাহাম লিঙ্কনের পর, এক পর্যায়ে মার্টিন লুথার কিং জুনিয়র বর্ণবাদ ও অর্থনৈতিক বৈষম্যের বিরুদ্ধে সিভিল রাইটস্ মুভমেন্ট গড়ে তুলে ছিলেন। ১৮৬৮ সালের এপ্রিল মাসে উগ্রপন্থি শে^তাঙ্গরা তাকেও গুলি করে হত্যা করে। (বর্ণবৈষম্য: ক্ষোভের আগুনে পুড়ছে যুক্তরাষ্ট্র, পৃষ্টা-১০৭)।

 

মাদকাসক্তি সমাজের একটি ভয়ানক ব্যধি। আমাদের সন্তানকে এই ব্যাধি থেকে নিরাপদ রাখতে প্রয়োজন একটু সচেতনতা। সচেনতাই কেবল আমাদেরকে এই অভিশাপ থেকে মুক্তি দিতে পারে। তাই যাদের পরিবারে উঠতি ছেলেমেয়ে রয়েছে, সে কোথায় যাচেছ, কার সাথে চলাফেরা করছে- সেব্যাপারে মা বাবা ও অভিভাবকদের লক্ষ রাখা প্রয়োজন। মাদকমুক্ত পরিবার ও সমাজ গঠনে প্রয়োজন আন্তরিকতা ও পারস্পরিক দায়িত্ববোধ। আমাদের ছেলেমেয়েদেরকে ছোটোবেলা থেকে কিছুটা নৈতিক শিক্ষা দেওয়াও প্রয়োজন বলে মনে করি। কোনটি ন্যায় কোনটি অন্যায়, কোনটি হালাল কোনটি হারাম, কোনটি গ্রহণীয় আর কোনটি বর্জনীয়- এইসব নৈতিক শিক্ষাগুলি যদি আমরা আমাদের সন্তানকে দিতে পারি, তাহলে এই ছেলে বা মেয়ে কখনো আর নষ্ট হবে না। অন্যথায় ছেলেমেয়েকে ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার, নার্স, একাউটেন্ট কিংবা ল-ইয়ার বানিয়ে কোনো লাভ হবে বলে আমার মনে হয় না। (মাদকমুক্ত সমাজ গঠনে চাই পারিবারিক সচেতনতা, পৃষ্টা-৮৩)।

 

এই অংশগুলো পাঠ করলে সহজেই প্রতীয়মান হয় যে, তাঁর লেখালেখির বিষয়বস্তুর মধ্যে সমাজ আছে, ইতিহাস আছে, সংস্কৃতি আছে, আছে সুস্থ চিন্তা চেতনার দ্যুতি। যেখানে পাঠকরা পাঠ করে নিজেকে বিষয়বস্তুর ভেতরে নিয়ে যেতে পারেন এবং লেখকের মুক্ত ভাবনার সাথে নিজের মুক্ত ভাবনার দিকটা যাচাই করে নিতে পারেন। তাঁর লেখার ভাষা বা বর্ণনা ঝরঝরে এবং জটিলতামুক্ত। সাধারণত সংবাদপত্রে প্রতিনিয়ত যে সহজ সরল ভাষা ব্যবহার করা হয় তিনিও সে ভাষা ব্যবহারে সিদ্ধহস্ত। বলা যেতে পারে, মুক্ত মনের ভাবনা পাঠ করে পাঠক উপকৃত হবেন এতে কোনো সন্দেহ নেই। তাঁর পূর্ব প্রকাশিত বই দুটি যেমন সুধী মহলের প্রশংসা কুড়িয়েছে তেমনি এই বইটিও সর্বমহলে গ্রহণযোগ্য হবে বলে আমি আশাবাদী।

 

অমর একুশে গ্রন্থমেলা-২০২৩ সালে সিলেটের কৈতর প্রকাশনী থেকে বইটি বের হয়। বইটির দৃষ্টি নন্দন প্রচ্ছদ এঁেকেছেন লুৎফুর রহমান তোফায়েল। ১২০ পৃষ্টার বইটির বাজার মূল্য নির্ধারণ করা হয়েছে ১২০ টাকা এবং ইউ এস মুদ্রায় ২০ ডলার। গুরুত্বপূর্ণ এই বইটি লেখক উৎসর্গ করেছেন, তাঁরই প্রয়াত সহোদর নজরুল হোসেন চৌধুরী, যিনি ১৯৭৫ সালে এম সি কলেজে অধ্যয়নকালে সড়ক দুর্ঘটনায় অল্প বয়সে পৃথিবী ছেড়ে চলে যান। বইটি সিলেটের কৈতর প্রকাশনী ছাড়াও মুক্তধারা, নিউইয়র্ক এবং প্রতিভা প্রকাশ, ঢাকায় পাওয়া যাচ্ছে। সেই সাথে অনলাইন পরিবেশক রকমারীডটকম এর মাধ্যমেও আগ্রহী পাঠকরা বইটি সংগ্রহ করতে পারেন।

সিলেটভিউ২৪ডটকম/পিডি/ইআ-০৯