বর্তমানে আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে অন্যতম আলোচিত প্রপঞ্চ হলো ক্লাইমেট জাস্টিস বা জলবায়ু ন্যায্যতা। বিশ্বনেতাদের, বিশেষত সরকার বা রাষ্ট্রপ্রধানদের কোনো সম্মিলন সামনে এলে এ নিয়ে তোড়জোড় শুরু হয়। সেটা জি৭, জি২০ বা ব্রিকস সম্মেলনই হোক, আর জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের অধিবেশনই হোক। জলবায়ু বা পরিবেশ সম্মেলন বা কোনো বিশেষ অধিবেশন হলে তো কথাই নেই।

এ সপ্তাহে শুরু হওয়া জাতিসংঘ সাধারণ অধিবেশনের প্রাক্কালে আজ ২০ সেপ্টেম্বর নিউ ইয়র্কে অনুষ্ঠিত হচ্ছে ‘ইউএনএসডিজি ক্লাইমেট অ্যাম্বিশন সামিট।’ ২০২১ সালে স্কটল্যান্ডে অনুষ্ঠিত ২৬তম জলবায়ু সম্মেলন (কপ-২৬) এবং গত বছর মিসরে অনুষ্ঠিত কপ-২৭-এ জলবায়ু ন্যায্যতার বিষয়টি গুরুত্ব পায়। এর আগে ২০০৯ সালে কোপেনহেগেন সম্মেলনে জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবেলায় উন্নয়নশীল অর্থনীতিগুলোকে অর্থ দেওয়ার সিদ্ধান্তেও জলবায়ু ন্যায্যতার বিষয়টি নিহিত। অথচ এর দুই যুগ পেরিয়ে গেলেও সে লক্ষ্য অর্জিত হয়নি।


তবে এ নিয়ে কথা হচ্ছে, প্রতিবাদ হচ্ছে, বিভিন্ন ফোরামে দর-কষাকষি হচ্ছে, জনমত তৈরি হচ্ছে। পরিবেশবাদী, জলবায়ু পরিবর্তনের ক্ষতির ঝুঁকিতে থাকা ও ক্ষতিগ্রস্ত দেশগুলো বিষয়টি নিয়ে সোচ্চার হচ্ছে, কথা বলার নৈতিক ও আইনগত ভিত্তি লাভ করেছে। আর ইউএনএসডিজি ক্লাইমেট অ্যাম্বিশন সামিট সামনে রেখে কয়েক মাস ধরে বাংলাদেশসহ সারা বিশ্বে পরিবেশবাদীরা জীবাশ্ম জ্বালানির ব্যবহার কমিয়ে জলবায়ু ন্যায্যতা নিশ্চিতে প্রতিবাদী কর্মসূচি পালন করে আসছে।

জলবায়ু ন্যায্যতার সরল কোনো সংজ্ঞা নেই।
বলা যায়, যেসব দেশ তাদের নীতিবিবর্জিত উন্নয়ন কর্মকাণ্ডের ফলে অন্য দেশের পরিবেশ ও জলবায়ুকে সংকটাপন্ন করে তুলেছে, জলবায়ু পরিবর্তনের ভয়াবহ প্রভাবের ঝুঁকিতে থাকা সেসব দেশকে ক্ষতিপূরণ দিতে হবে, বিশেষ করে জীবাশ্ম জ্বালানির ব্যবহার করে নিজেরা উন্নত হয়ে এর ক্ষতিকর প্রভাবে জলবায়ু পরিবর্তন ও পরিবেশগত বিপর্যয়ের ক্ষতিকর প্রভাবের ঝুঁকিতে থাকা দেশগুলোর পাশে দাঁড়াতে হবে। আর জীবাশ্ম জ্বালানিসহ পরিবেশগত বিপর্যয় সৃষ্টিকারী কর্মকাণ্ড থেকে যত দ্রুত সম্ভব বের হয়ে আসতে হবে। এই মুহূর্তে অন্তত একটি পরিকল্পনা প্রকাশ করতে হবে।

জীবাশ্ম জ্বালানির সবচেয়ে বড় তিন উপাদান হলো কয়লা, প্রাকৃতিক গ্যাস ও খনিজ তেল। এসব জ্বালানি প্রাথমিক পর্যায়ে ব্যবহৃত হয়।
যার দ্বিতীয়বার ব্যবহার নেই। এসব জ্বালানি ব্যবহারের ফলে বাতাসে কার্বনসহ বায়ু তথা পরিবেশদূষণকারী উপাদান বেশি নিঃসরণ হয়। এভাবে বিগত ১৫০ বছর ধরে বিশ্বের ৮০ শতাংশ জ্বালানির উৎস হিসেবে কাজ করছে জীবাশ্ম জ্বালানি। ফলস্বরূপ বায়ুদূষণ, বৈশ্বিক উষ্ণতা বৃদ্ধি, উত্তর মেরুর বরফ গলে সমুদ্রের জলরাশির উচ্চতা বৃদ্ধিসহ পরিবেশ ও প্রতিবেশের ওপর পড়ছে বিরূপ প্রভাব।

জীবাশ্ম জ্বালানি ব্যবহারকারী শীর্ষ দেশগুলো হলো—চীন, যুক্তরাষ্ট্র, ভারত, রাশিয়া, জাপান, কানাডা, ব্রাজিল, দক্ষিণ কোরিয়া, জার্মানি, ইরান, সৌদি আরব ও ইন্দোনেশিয়া। স্বাভাবিকভাবেই এসব দেশ কার্বন নিঃসরণেও রয়েছে শীর্ষে। আর এসব উন্নত দেশের পরিবেশবিধ্বংসী পাপাচারের প্রায়শ্চিত্ত করছে দরিদ্র দেশ তথা জীবাশ্ম জ্বালানি তুলনামূলক কম ব্যবহারকারী দেশগুলো। ভৌগোলিক অবস্থানগত কারণে বাংলাদেশ, মালদ্বীপ, শ্রীলঙ্কার মতো দেশগুলোর অবস্থা খাদের কিনারায়।

২০২১ সালের গ্লাসগো সম্মেলনে বড় ও শক্তিশালী দেশগুলো জীবাশ্ম জ্বালানি ব্যবহার বন্ধে রাজি না হলেও একটি মন্দের ভালো ছিল—এ খাতে ভবিষ্যতে অন্তত নতুন বিনিয়োগ করবে না। তবে পরিতাপের বিষয় হলো চীন, যুক্তরাষ্ট্র, জাপানের মতো দেশ এসব সমঝোতার ধারে-কাছেও আসে না; বরং সমঝোতায় পৌঁছানোর অন্যতম বাধা হয়ে দাঁড়ায়। এভাবে বছরের পর বছর উন্নত দেশগুলোর ভূমিকায় পরিবেশ সম্মেলনগুলো অনুন্নত ও জলবায়ু পরিবর্তনের ঝুঁকিতে থাকা দেশগুলোকে হতাশ করছে। এদিকে জি৭-ভুক্ত দেশগুলো শুধু ২০২২ সালে জীবাশ্ম জ্বালানি খাতে ১.৪ ট্রিলিয়ন ডলার খরচ করেছে। আর এই মুহূর্তে সবচেয়ে বড় অর্থনৈতিক ফোরাম জি২০-ভুক্ত দেশগুলোর জ্বালানি পরিকল্পনায়ও জীবাশ্ম জ্বালানি থেকে বের হয়ে আসার তেমন পরিকল্পনা পরিলক্ষিত হচ্ছে না।

অন্যদিকে জীবাশ্ম জ্বালানির শীর্ষ মজুদকারী দেশগুলো নতুন এক ফন্দি এঁটে দরিদ্র দেশগুলোকে নতুন সংকটে ফেলছে। নিজেরা কয়লাসহ জীবাশ্ম জ্বালানিতে নতুন বিনিয়োগ না করলেও জলবায়ু পরিবর্তনের ঝুঁকিতে থাকা দেশগুলোকে জীবাশ্ম জ্বালানিতে সহায়তা দিচ্ছে। তাদের মজুদ তথা অব্যবহৃত জীবাশ্ম জ্বালানি পোড়ানোর চুল্লিতে পরিণত করার দূরভিসন্ধিতে পা ফেলছে আমাদের দেশের মতো জলবায়ু পরিবর্তনের হুমকিতে থাকা দেশগুলো। এতে উভয়মুখী সংকটে পড়ছে এসব দেশ। একদিকে জীবাশ্ম জ্বালানির ক্ষতিকর প্রভাব পড়ছে প্রাণ-প্রকৃতি ও পরিবেশ-প্রতিবেশের ওপর, অন্যদিকে তারা জলবায়ু ন্যায্যতা নিশ্চিতে উন্নত দেশ ও ব্যাবসায়িক গোষ্ঠীগুলোকে জীবাশ্ম জ্বালানি ব্যবহারে বাধা ও তাদের কাছ থেকে ক্ষতিপূরণ আদায়—উভয়টির নৈতিক ভিত্তি হারিয়ে ফেলছে। এভাবে জলবায়ু রাজনীতি ও জলবায়ু কূটনীতি থেকে নিজেদের অবস্থান সংহত করতে পারছে না উভয় সংকটে থাকা দেশগুলো।

এ সপ্তাহের ইউএনএসডিজি ক্লাইমেট অ্যাম্বিশন সামিটের ডিজাইন ও আউটকাম তিনটি স্বতন্ত্র কিন্তু আন্ত সম্পর্কিত ধারা হলো উচ্চাকাঙ্ক্ষা, বিশ্বাসযোগ্যতা ও বাস্তবায়ন। উচ্চাকাঙ্ক্ষা বলতে ২০২১ সালের গ্লাসগো সম্মেলনের অঙ্গীকার তথা ২০৩০ সালের মধ্যে কার্বন নিঃসরণ উল্লেখযোগ্য মাত্রায় কমিয়ে এনে শূন্য নির্গমনের দিকে অগ্রসর হওয়া। তাপমাত্রা বৃদ্ধি ১.৫ ডিগ্রি সেলসিয়াসের মধ্যে রাখার বিশ্বাসযোগ্য পরিকল্পনা গ্রহণের ব্যাপারটি সেখানে গুরুত্ব পাবে। সর্বশেষ সম্মেলনে অংশগ্রহণকারী রাষ্ট্রগুলো, ব্যবসায়ীগোষ্ঠীগুলো, আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক সংস্থা এবং আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো, বেসরকারি প্রতিষ্ঠান ও নাগরিক সমাজের প্রতিনিধিরা উচ্চ কার্বন নির্গমনের চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করে জলবায়ু ন্যায্যতা বাস্তবায়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবেন—এটাই প্রত্যাশা।

*লেখক: উপাচার্য, মেট্রোপলিটন ইউনিভার্সিটি, সিলেট
ও আজীবন সদস্য, বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলন (বাপা)
[email protected]

(দৈনিক কালের কন্ঠ পত্রিকায় প্রকাশিত)