কল্পনা করুন , এক অসমসাহসী নারী, বাংলাদেশের ঝা-চকচকে বৃহত্তম বন্দর নগরীর হট্টগোলের মাঝে; রাজপথে, সড়কে, খালি পায়ে ঘুরে বেড়াচ্ছেন এক মহৎ প্রাণ ও আকাঙ্ক্ষা নিয়ে!! এই মহান মহিলা সম্পর্কে জানতে, আসুন তবে আমি আপনাদের নিয়ে যাই এক চেতনাগত ভ্রমণে। আমরা স্মৃতির অলিগলি পেরিয়ে চলে যাই আজ থেকে অর্ধ-শতাব্দীরও অধিক পূর্বকালে:- বলছি বাংলাদেশের এক নারীর কথা। কাঁধে ঝোলা, খালি পায়ে হেঁটে বই বিক্রি করা ফেরিয়ালা, একাত্তরের নির্যাতিতা জননী রমা চৌধুরী ।

আমাদের স্বাধীনতার বিজয়ের ইতিহাসে নারীদের অবদান খুব একটা তুলে ধরা হয় না। নারীদের বীরত্ব আর ত্যাগের ফলে বাংলাদেশ স্বাধীন হয়েছিল ৯ মাস রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের মাধ্যমে । মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তানি হানাদারবাহিনীর হাতে লক্ষ, লক্ষ নারীর সম্ভ্রমহানি আর নির্যাতন হয়েছিলো । নিষ্ঠুর নির্যাতনের শিকার হয়েছিল কিশোরী, বিবাহিত মহিলারা এবং সর্বস্তরের ও সববয়সের নারী। অনেক নারী সম্ভ্রম হারানোর পর আত্মহত্যা করেছিলেন সমাজের ভয়ে, লজ্জায় ও নিগৃহীত হবার ভয়ে । ১৯৭১ এর বিভীষিকাময় দিনগুলোতে কত নারী পাকিস্তানের সেনাদের দ্বারা নির্যাতিত হয়েছিল তার কোন সঠিক তালিকা নেই ।


চট্টগ্রামের রমা চৌধুরী ছিলেন উচ্চশিক্ষিতা। সেই সময়কার দক্ষিণ চট্টগ্রামের প্রথম নারী এমএ পাস ছিলেন তিনি। বাংলা ভাষা ছড়িয়ে দেওয়ার লক্ষ্যে তিনি শিক্ষকতাকে পেশা হিসেবে গ্রহণ করে, দিনযাপন করেছিলেন। প্রধান শিক্ষিকার দায়িত্ব পালন করেছিলেন । শিক্ষার আলো সমাজে ছড়িয়ে দেয়ার লক্ষ্যে তিনি শিক্ষকতাকে পেশা হিসেবে গ্রহণ করে বিভিন্ন উচ্চ বিদ্যালয়ে প্রধান শিক্ষিকার দায়িত্ব পালন করেছিলেন । ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের উত্তাল সময়ে তিনি ছিলেন তিন সন্তানের জননী । তখন তিনি বাস করছিলেন পৈত্রিক বাড়িতে । যুদ্ধের সময় স্বামী ভারতে চলে যান । তিন পুত্র সন্তানকে আগলে রেখে শিক্ষকতা করছিলেন। নিজের জীবনের ধ্যান-জ্ঞান ছিল সমাজকে আলোকিত করা ।

১৯৭১ সালের ১৩ই মে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী তাঁর বাড়ি ঘিরে ফেলে । ঘরে তখন তিন সন্তান আর বৃদ্ধা মা। পাকিস্তানি সেনারা তাঁর উপর পাশবিক নির্যাতন করে, তিনি ধর্ষিতা হন । ধর্ষণের পর পাকিস্তানি হানাদারদের হাত থেকে বাঁচতে পুকুরে লাফ দিয়ে লুকিয়ে ছিলেন । হানাদারবাহিনী গান পাউডার দিয়ে তাঁর ঘরবাড়ি পুড়িয়ে দেয়। থাকার জায়গা নেই! শুরু হয় এক ভীষণ দূর্বিষহ জীবন! ঘরবাড়ি নেই, খাবার নেই!!! ছোট ছোট সন্তান আর বৃদ্ধা মা। কোথায় যাবেন? আবার ভয় ছিল, যদি পুনরায় হানাদারদের চোখে পড়েন, তখন বেঁচে থাকারও সম্ভাবনা থাকবে না। দিনের বেলায় জঙ্গলে লুকিয়ে থাকতেন। রাতের বেলা চুপি চুপি নিজের বাড়িতে এসে প্রচন্ড কষ্টে তীব্র মানসিক যন্ত্রণা নিয়ে ভেঙে পড়তেন। ছোট তিন সন্তান আর বৃদ্ধ মায়ের কথা ভেবে আত্মহত্যার পথ থেকে বিরত থেকেছেন । সে সময় ধর্ষিতা নারীদের সমাজে ভালো চোখে দেখতো না। তাঁর আত্মীয়-স্বজনরাও তাঁকে সহায়তা করে নি, সঙ্গ দেয়নি ।

অনেক রক্তের বিনিময়ে বাংলাদেশ স্বাধীন হয় ১৯৭১ সালের ১৬ই ডিসেম্বর । ১৫ই ডিসেম্বর তাঁর বড় ছেলে ছয় বছর বয়সী সাগরের শ্বাসকষ্ট শুরু হয়। ২০ ডিসেম্বর মারা যায়। ১৯৭২ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি, মারা যায় তার আরেক ছেলে টগর । দুই সন্তান হারানো এক মায়ের জন্য এই পরিস্থিতি যে কত বেদনাময়, তা ভাষায় বলা যায় না । নিজের সম্ভ্রম হারানো, ঘরবাড়ি ,সম্পদ হারানো- আর বিজয়ের পথে দুই সন্তান হারানো, এক জননীর জন্য কতটা কষ্টের তা ভাষায় বলা যায়না। প্রথম স্বামী যুদ্ধের পর তাঁকে ফিরিয়ে নেয়নি । প্রথম সংসারের পর দ্বিতীয়বার বিবাহ করেন। কিন্তু দ্বিতীয় স্বামী দ্বারাও উনি প্রতারিত হন। সেই সংসারের জন্ম নেয়া ছেলে টুনু, সড়ক দুর্ঘটনায় মারা যায় ১৯৯৮ সালে। দুঃখ আর কষ্ট তাঁর জীবনসঙ্গী হয়ে ধরা দেয়। নিজের মাতৃভূমিকে ভালোবাসতেন মনেপ্রাণে। তিনি ইচ্ছা করলে ভারতে চলে যেতে পারতেন কিন্তু যাননি ।

দেশপ্রেমিক রমা চৌধুরী, শিক্ষার আলো ছড়িয়ে সমাজ আর নতুন প্রজন্মকে আলোর দিশারী হওয়ার জন্য অনুপ্রেরণা দিয়েছিলেন । স্বাধীনতা যুদ্ধে সর্বোচ্চ ত্যাগ স্বীকার করেছেন। সর্বস্ব হারিয়েছেন। তারপরও মনোবল হারাননি। নিজের দেশকে অন্তর দিয়ে ভালোবেসে ছিলেন। নিজের দুই সন্তান মাটির নিচে শুয়ে আছে , তিনি কি করে সেই মাটির উপর জুতো দিয়ে মাড়িয়ে বেড়াতে পারেন??? তাই তিনি খালি পায়ে হেটে নিজের লেখা বই বিক্রি করতেন।  তার লেখা "একাত্তরের জননী" গ্রন্থে তার মনোবেদনার উল্লেখ করেছেন এই ভাবে “ পাকিস্তানি বাহিনী আমাকে প্রাণে না মারলেও আমার আত্মার অপমৃত্যু ঘটিয়েছে, যার ফলে নেমে এসেছে জীবনে শোচনীয় পরিণতি। আমার দুটি মুক্তিপাগল অবোধ শিশুর সাধ-স্বপ্ন, আশা-আকাঙ্ক্ষাভরা জীবন কেড়ে নিয়েছে বাংলার মুক্তিসংগ্রাম। আমার কাঁধে ঝোলা, খালি পা ও দুঃসহ একাকিত্ব একাত্তরেরই অবদান।" স্বাধীনতার পরে তিনি লেখালিখিতে মনোনিবেশ করেন। একটি পাক্ষিক পত্রিকায় লিখতেন । সম্মানীর বদলে সেখান থেকে পত্রিকার ৫০টি কপি নিয়ে, নিজ হাতে বিক্রি করতেন। আর তিনি নিজের লেখা অন্যান্য বইগুলোও খালি পায়ে হেঁটে হেঁটে বিক্রি করতেন। সেখান থেকে যা আয় আসতো তা দিয়ে তিনি জীবনযাপন করতেন। স্বাধীনতা সংগ্রামে উনি সর্বস্ব হারিয়েও এই দেশকে ভালোবাসতেন। দেশের মঙ্গল কামনা করতেন।

বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে নির্যাতিতা অনেক বীরাঙ্গনা এখনও বেঁচে আছেন । সরকার এবং আমাদের সবার উচিত, এই সব নির্যাতিতা বীরাঙ্গনাদের খুঁজে বের করে তাদের প্রাপ্য সম্মানটুকু দেয়া। তাদের ইতিহাসটুকু যেন হারিয়ে না যায়। বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে নির্যাতিতা বীরাঙ্গনরা আমাদের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসের অংশ। দুঃসহ বেদনার এ কণ্টক পথ বেয়ে শোষণের নাগপাশ ছিঁড়লে যারা আমরা তোমাদের ভুলব না। যুগের নিষ্ঠুর বন্ধন হতে মুক্তির এ বারতা আনলে যারা আমরা তোমাদের ভুলব না।। মহান বিজয় দিবস উপলক্ষে সবাইকে আন্তরিক শুভেচ্ছা ও অভিনন্দন।


লেখক: আস্থা মাহমুদ, শিক্ষার্থী, মাস্টারমাইন্ড স্কুল, ঢাকা।