বাংলাদেশের গ্রাম ও ছোটো শহর ভিত্তিক একান্নবর্তী পরিবারের পারিবারিক মধুর সম্পর্কের যে ছবি আমাদের মতো পঞ্চাশোর্ধ মানুষের চোখের সামনে সোনালী দিনের মতো আজ-ও ভাসে; সেই মধুর পারিবারিক সম্পর্কে দিনে দিনে একে অন্যের সাথে দূরত্ব বাড়ার এক বিচ্ছিরি প্রতিযোগিতা যেনো চলছে আমাদের সমাজে। এ সম্পর্কে পত্রিকায় লেখা হচ্ছে 'ভেঙে যাচ্ছে একান্নবর্তী পরিবার' ইত্যাদি শিরোনাম দিয়ে। এ সম্পর্কে এখন প্রায় সকল পরিবারেই একটা গুমোট পরিস্থিতি চলছে। আমি সরাসরি কিছু পরিবারের এমন পারিবারিক পরিস্থিতি দেখেছি এবং আরও অনেক যৌথ পারিবারিক সম্পর্কের ফাটল নিয়ে বিভিন্ন খবরাখবর পত্রিকা বা বিভিন্ন মাধ্যমে জেনেছি। আমি অনুসন্ধানী মনোযোগী হওয়ার চেষ্টা করে, যৌথ পরিবারের খুব কাছের একেবারে রক্ত সম্পর্কীয় মানুষদের মধ্যে দূরত্ব বাড়ার কতোগুলো সুনির্দিষ্ট কারণ খুঁজে পেয়েছি। তবে আশার কথা যে, দুই তিন যুগেরও বেশি সময় যৌথ পরিবার থেকে বিচ্ছিন্ন থেকে এখন অনেকেই উপলব্ধি করতে পারছেন একান্নবর্তী পরিবারের গুরুত্ব।  এ সবের উপর ভিত্তি করে আমার এই লেখা। 

 


পরিবার কাকে বলে? এই প্রশ্নের উত্তর ইউরোপ আমেরিকার মানুষ যেমন বুঝে বাংলাদেশের মানুষের কাছেও পরিবারের একটা সংজ্ঞা আছে। সাধারণত কিছু মানুষ একত্রে মিলে বসবাস করা এবং রান্না, খাওয়া ও বিভিন্ন বিষয়ে একত্রে সমঝোতা করে মেনে নিয়ে যারা চলে তাদেরকে একটা পরিবার বলা যায়। আবার রক্ত সম্পর্কীয় অনেক আত্মীয় একত্রে এক বাড়িতে এক-ই রান্নাঘরে রান্না করে মিলে খায় ও বসবাস করে যারা তাদেরকে একটা পরিবার বলা যায়। তবে আমাদের দেশে এখন ভিন্ন ভিন্ন কাজে দূরে দূরে থাকলেও বিভিন্ন পারিবারিক, সামাজিক ও ধর্মীয় উৎসবে অনেকে একত্রে মিলে যাওয়ার চিত্রই বৃহৎ অর্থে যৌথ পরিবার হিসেবে দেখা যায়। মূলত এখনও পরিবার বলতে বুঝি মা বাবা দাদা দাদি ও ভাই বোন মিলে পৈত্রিক বাড়ির সুবিধা সমান ভাবে ভোগ করে পারিবারিক ও সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমে একত্রে মিলে চলা। তবে সবসময় ওই সংজ্ঞার পরিধি এক থাকে না। অর্থনৈতিক, সামাজিক, শিক্ষার প্রভাবে বৃহৎ পরিবারের সকলের মানসিকতা এক রকম হয় না, এমনকি মানসিকতার অনেক অনেক পার্থক্য হয়ে যায়। নানাবিধ কারণে পরিবারের সংজ্ঞার ধারণাও একেকজনের কাছে ভিন্ন ভিন্ন হয়ে যায়। 

 

যৌথ পরিবার বাঙালি জাতির ঐতিহ্য বলা যায়। এতে বহু রকম সুবিধা ভোগ করা যায়। আমরা বাংলাদেশে বিংশ শতাব্দীর আশির দশকে ও নব্বই দশকের মাঝামাঝি সময়েও দেখেছি পরিবারের চাচারা বা ভাইয়েরা কেউ কৃষিকাজ, কেউ ব্যবসা, কেউ চাকরি করলেও দাদা দাদি কেন্দ্রীক পরিবারের সকল কাজে সকলের মতামতের ভিত্তিতে সিদ্ধান্ত হতো। এরপর থেকেই কিন্তু আমরা দেখতে পাই ধীরে ধীরে ওই দাদা দাদি কেন্দ্রীক পরিবারের গুরুত্ব কমতে শুরু করে। একবিংশ শতাব্দীর শুরুর পরে পরিস্থিতি আরও দ্রুত বদলাতে শুরু করে। এখন দেখা যায়, দাদা দাদি ও মা বাবা কেন্দ্রীক কোনো পরিবারের এক বা একাধিক ছেলে বা মেয়ে যখন বৈবাহিক সূত্রে নতুন কোনো পরিবারের সাথে আত্মীয়তার সম্পর্কে জড়ায় তারপর থেকেই ওই পরিবারের দীর্ঘদিন ধরে চলে আসা অনেক অভ্যাসে পরিবর্তন চলে আসতে শুরু করে। এখান থেকেও যৌথ পরিবার ভাঙনের গর্জন উঠে। দিনে দিনে ভাইয়ে ভাইয়ে, ভাইয়ে বোনে এমনকি পুত্রবধূর প্রভাবে মা বাবার সাথে ছেলের দূরত্বও বেড়ে যায়। পিতা মাতার বাড়িতে হেসে খেলে বেড়ে উঠা মেয়ের অবস্থা বিয়ের পরে খুবই দুঃখজনক চেহারায় ফিরে। বিয়ের পরে মা-বাবা যতোদিন বেঁচে থাকেন ততোদিন মেয়েরা বাবার বাড়িতে যেতে পারলেও মা-বাবা মারা যাওয়ার পরে বোনেরা আর সেই পূর্বের অধিকার নিয়ে বাবার বাড়িতে যেতে পারে না। এমনটা হওয়ার অনেকগুলো কারণের অন্যতম কারণ খুঁজে পাওয়া যায় — বোনেরা যাতে পৈত্রিক বাড়ির সুবিধা বা পৈত্রিক ও মায়ের সম্পদ দাবি করতে না-পারেন সেজন্যে আগে থেকেই বোনদেরকে সরিয়ে রাখার একটা প্রবনতা ভাই, ভাবী ও ভাইপোর মাঝে কাজ করে। একটু চোখ কান খোলা রেখে আমাদের সমাজের দিকে অনুসন্ধানী মানুষ হিসেবে তাকালে দেখা যায়, লেখাপড়া জানা ও নিয়মিত বায্যিক যতো রকম ধর্মীয় আচার অনুষ্ঠান যেমন নামাজ, পশু কোরবানি, মক্কা মদিনার পথে যাত্রা, শিন্নী করা ইত্যাদি কাজ যেসব ভাইয়েরা করেন তাদের মধ্যেও একটা অংশ আছেন যারা পৈত্রিক বাড়িতে বা পৈত্রিক বাড়ির প্রাঙ্গনে এবং মা-বাবার রেখে যাওয়া সম্পত্তিতে আগ বাড়িয়ে বোনদের অধিকার বুঝিয়ে দেন না এবং তারা সারাজীবন ওই সম্পত্তি একা একা ভোগ করেন। অথচ আমাদের ইসলাম ধর্ম মতে পবিত্র কোরআনে স্পষ্ট ঘোষণা এসেছে প্রাপ্ত বয়স্ক বোনদের সম্পত্তি তাদেরকে বুঝিয়ে দেয়ার জন্যে। এটা আল্লাহর হুকুম। পৈত্রিক সম্পত্তির অংশ শুধু ভাইয়ের নয় এটা বোনদের হক। ওই সম্পত্তি বোনদেরকে বুঝিয়ে দেয়া ভাইদের ধর্মীয় ও নৈতিক দায়িত্ব। আর বোনদের অজ্ঞতা ও সরলতার সুযোগ নিয়ে ওই সম্পত্তি বুঝিয়ে না-দিয়ে ভাইয়েরা বছরের পর বছর নিজেদের দখলে রাখা রীতিমতো বোনদের হক আত্মসাৎ করার সামিল অনৈতিক কাজ। এখনও আমাদের সমাজের বোনেরা ভাইদের কাছে নিজেদের অধিকার নিয়ে জোরালো ভাবে দাবি করে না। কিন্তু ; ধর্ম বলে, ভাইয়েরা বা পিতার অবর্তমানে অভিভাবকরা নিজ দায়িত্বে উদ্যোগী হয়ে বাড়ির মেয়েদের বিয়ের বয়স হলে বা বুঝ-জ্ঞান হলে পৈত্রিক সম্পত্তি মেয়েদেরকে বুঝিয়ে দিবেন। এ-তো ধর্মের অবশ্য পালনীয় হুকুম। এখন দৃষ্টি দিই বাংলাদেশের আইনের দিকে। সেখানেও দেখা যায়, পিতা ও মাতার স্থাবর ও অস্থাবর সম্পদে ছেলেদের মতো মেয়েদেরও নির্দিষ্ট পরিমাণ অধিকার রয়েছে। এসব কিছুই আমাদের সমাজের মানুষরা জানেন এবং কেউ কেউ না-জানার ভান করে চলেন ও বোনদের সম্পত্তি কুক্ষিগত করে রাখেন। এখন যেহেতু আমাদের দেশের মেয়েরা শিক্ষা সচেতন, তাই তারা অধিকার সচেতন হয়ে যখনই তাদের অধিকার নিয়ে তাদের ভাইয়ের কাছে সাধারণ একটা কথাও তোলেন তখনই কোনো কোনো ভাইদের আসল চেহারা ফুটে উঠে। তখন ভাইয়েরা নানান ভাবে বোনদেরকে বঞ্চিত করার কৌশল গ্রহণ করে। এমনকি এমনটাও ঘটে থাকে - যদিও দুই বা ততোধিক ভাইদের মধ্যে অন্যান্য কারণে বিরোধ থাকে, কিন্তু ; যখনই কোনো বোন পিতা - মাতার সম্পদে তার ধর্মীয় ও রাষ্ট্রীয় অধিকার বিষয়ে একটু সচেতন হয়েছে, তখনই ভাইয়েরা বোনের বিরুদ্ধে একজোট হয়ে যায়। এ হচ্ছে আমাদের সমাজের মধুর পারিবারিক সম্পর্কের বিরোধের এক কারণ। এরপরও থাকে এক ভাই আরেক ভাইকে ঠকানো, অসহনশীল মনোভাব ইত্যাদি কারণেও যৌথ পরিবার ভাঙনের ধাক্কা লাগে। 

 

যৌথ পরিবারে একে অন্যকে ঠকালে দিনে দিনে জটিলতা বাড়ে। দেখা গেছে, বাহিরের কোনো মানুষের কাছে থেকে পাওনা আদায় করা সহজ হয় যৌথ পরিবারে ঐক্য থাকলে। আবার বৃহৎ পরিবারের একজন যদি এক-ই পরিবারের অন্য কাউকে ঠকায় তখন ওই পাওনা আদায় কঠিন হয়ে যায় অনেক সময়। এতে করে সমস্যা আরও বাড়তে থাকে। এদিকে সচেতনতা দরকার। বৃহৎ পরিবারে ভাঙনের ধারণা মোটামুটি আমাদের সমাজের মানুষরা রাখেন। কিন্তু ; এখন ছোটো পরিবার অর্থাৎ একান্ত আপন পরিবারও ভাঙনের মুখে পড়তে দেখা যায়। এখন শহুরে সমাজের ছোটো পরিবারের একটা অন্যতম পারিবারিক বিরোধ প্রায়শই পাশের গাছের ডালে বসে পাখির চোখে দেখা যায়, তা হলো, বউ ও শাশুড়ি বনিবনা না-হওয়া। এটাকে অবশ্য আমি এখনও খুব জটিল সমস্যা মনে করছি না। একটু উদার শিক্ষা গ্রহণ করলে ঠিক হয়ে যায়। ছেলে ও মেয়ের মায়েরা বিয়ের আগেই এ বিষয়ে উভয়ের সাথে কথা বলে একটা প্রস্তুতি নিয়ে তারপর আত্মীয়তার সম্পর্কের দিকে এগিয়ে গেলে ঠিকঠাক মতো চলবে। এখানে নতুন বউকে প্রস্তুতি নিতে হবে বিয়ের পরে তাকে একটি পরিবারের অন্যান্য পরিচালকের মতো নিজেও কিছু ভূমিকা রাখতে হবে। আবার শাশুড়িকেও এমন প্রস্তুতি নিয়ে রাখতে হবে যে নতুন বউ নতুন মানুষ হিসেবে তাকেও ছাড় দিতে হবে। তাহলে ধীরে ধীরে ঠিকঠাক মতোই চলবে। আপাতত এখানে অধিক মনোযোগ দিতে হবে। তাহলে অন্তত নতুন জন্ম নেয়া শিশুটি দাদা দাদি চাচা ফুপু ও নানার বাড়ির খুব কাছের মানুষের মায়া থেকে বঞ্চিত হয় না। বিশেষ করে নানার বাড়ির চাহিদা শিশুকালেই বেশি থাকে। শিশুরা চাচা, ফুপু ও মামাদের মায়া পেয়ে খুশি হয়। একটু সচেতন হলে এটা ধরে রাখা যায়।

 

পরিশেষে বলা যায়, নগর জীবনে অভ্যস্থ হয়ে ভিন্ন ভিন্ন সামাজিক ও শিক্ষা ব্যবস্থায় ভিন্ন ভিন্ন মানসিক প্রস্তুতি নিয়ে বেড়ে উঠার কারণে এবং অর্থনৈতিক কারণে আগের মতো এখন আর একটা বড়ো বাড়িতে ২৫ জন ৩০ জন একসাথে থাকা সম্ভব না। তবে পারিবারিক সম্পর্কে দূরত্ব বাড়ার কারণগুলো চিহ্নিত করে বিশেষ করে যৌথ সম্পত্তির সুষ্ঠু বন্টন বিষয়ে সচেতন ও আত্মীয়তার সম্পর্কের অধিকার বিষয়ে সচেতন থাকলে বিভিন্ন রকম কর্ম ব্যস্ততায় দূরে দূরে থাকলেও পরিবারের বিভিন্ন সামাজিক অনুষ্ঠানে সবাই মিলে চলতে অসুবিধা হওয়ার কথা না। এমন পরিবার এখনও অনেক দেখা যায়। হ্যাঁ, স্বীকার করতে হবে যৌথ পরিবারের পারিবারিক যোগাযোগ মানুষকে সাহসী করে উদার হতে শিক্ষা দেয়।।

 

লেখক-মোহাম্মদ আব্দুল হক, কলামিস্ট