ইটাউরি জামে মসজিদ। স্থপতি : শাকুর মজিদ

নভেল করোনা ভাইরাসের ভয়াল ছোঁবলে যখন গোটা মানবকুল জড়োসড়ো, ভয়ে আকীর্ণ হতাশার চাদরে ঢেকে যাওয়া চারপাশের মুখ, মানুষের সঙ্গ এড়িয়ে নিজেকে রক্ষাই যখন পন্থা, হোম কোয়ারেন্টাইনে ফ্লাটের চারদেয়ালে বন্দিসময় কাটানো যখন ছিল নিয়তি, আতঙ্কের উদ্বেগের অতিক্রান্ত হচ্ছিল মুহূর্ত, প্রতিক্ষণ, সেই সময়ে বইটি লেখার পরিকল্পনা আসে মাথায়। ওই কালসময় চোখে চোখ রেখে আমাদের আতংকিত করে তুলেছিল, জারী রেখেছিল অশনি সংকেত। ভেতরে ভেতরে তোলপাড় তুলেছিল নানা প্রশ্ন। জীবন-মৃত্যু এসব নিয়ে এমন অখণ্ড ভাবার সুযোগ এ জীবনে এর আগে কখনো আসেনি। কেনই বা জীবন, কি-বা জীবন। জীবনের উপসংহারই বা কি? আমার আগে কারা ছিলেন, কিভাবে ছিলেন, আমার পরে যারা আসবেন, তার পরে যারা তার তো সন্ধান লইতে পারলাম কই! যে-গ্রামে জন্মেছি, সেই গ্রামের এ জাতীয় কোনও প্রশ্নের পূর্বাপর উত্তর খুঁজতে বসিনি কখনও। এখানে কারা ছিলেন, যারা আছেন, যারা থাকবেন, তাদের একজন হয়েও আমি খবর লইতে পারলাম না কিছু। এ কত বড় গ্লানির, কত অপমানের; মস্ত অর্বাচীনের কাজ ! যে মাটি আমাকে উগড়ে দিল, বাঁচাল এবং তার দেহে আগলে রাখবে অনন্তসময়; সেই ভূমি তো স্বর্গাদপী গরিয়সী!

এইসব সাতপাঁচ ভাবতে ভাবতে দু হাজার একুশ সালে তিন এপ্রিল শুক্রবার সকালে এই পাণ্ডুলিপি তৈরির কথা ভেবেছি ঘণ্টাখানেক, তারপর বসে পড়লাম লিখেতে। লিখতে বসে দেখলাম বেশ তো এগুচ্ছে লেখা, কলকল নদীর স্রোতের মতো ছুটে চলেছে কলম। এক বসাতে লেখা হয়ে গেলো তার বিশ পৃষ্ঠা। আত্মবিশ্বাস বেড়ে গেলো। আরো দু-একদিনের বসায় বইটির মোটামুটি একটি অবয়ব দাড়িয়ে গেলো। সামাজিক ইতিহাস তৈরির কাজটি মোটেও মামুলি প্রসঙ্গ নয়। কত প্রসঙ্গের উত্তর খুঁজতে হয় জনইতিহাস লেখার জন্য। শিক্ষা, প্রত্ন, ধর্ম, সভ্যতা, সংস্কৃতি, অর্থনীতি ইত্যাকার বহুবিধ বিষয়। এ রকম কাজের মূল্য ইতিহাসের কাছে অনেক, অমূল্য। সেই বিবেচনায়, বাংলাদেশের চুরাশি হাজার গ্রামের একটি গ্রাম ইটাউরির ইতিহাস গ্রন্থটি বাংলাদেশের সামগ্রিক ইতিহাস রচনায় সামান্য হলেও অবদান রাখবে।


এবার বলি, বইটা লেখার নেপথ্যে কী ছিল প্রেরণাসঞ্চারক, তার প্রসঙ্গে। আমার ঘনিষ্ঠজনেরা জানেন, আমি ছাত্রাবস্থায় সাহিত্যচর্চায় ঝুঁকে পড়ি। ইন্টারমিডিয়েট পরীক্ষার ফলাফল প্রত্যাশার অবসরকালে প্রকাশ করি সাহিত্যপত্র ‘উদ্দাম’। গাটের পয়সা খরচা করে দিনের পর দিন বিয়ানীবাজারের মদিনা প্রেসে বইটি ছাপার উপযোগী হয়, তারপর লন্ডন প্রবাসী নানি জোবেদা আলীর উপহারের টাকাটা ওর পেছনে ব্যয় করে আলোর মুখ দেখে উদ্দাম। শাহবাজপুর হাইস্কুলে ওর একটি প্রকাশনা অনুষ্ঠান করে বন্ধুরা। অনুষ্ঠানের পর শাহবাজপুর স্টেশনবাজারে দল বেঁধে দোকানে দোকানে বিক্রি করে কিছু টাকা ফেরতও পেয়েছিলাম।

ইন্টারমিডিয়েট পাসের পর দ্রুত স্নাতক সম্পন্ন করে ইংল্যান্ডে পাড়ি জমানোর পরিকল্পনা থেকে আমি মদন মোহন কলেজে পাস কোর্সে বিকম গ্রাজুয়েশনের জন্য ভর্তি হই। এসএসসি-তে মানবিক শাখায় প্রথম বিভাগ এবং এইচএসসি-তে উচ্চনম্বরসহ দ্বিতীয় বিভাগ পাওয়ার পরও আমি অন্য কোনও কোর্স খুঁজিনি দু-বছরে পড়ালেখা সেরে ফেলার অভিপ্রায়ে। এই সংকল্প বেশি দিন টেকেনি, অল্পদিনের মধ্যে টুটে যায়। সাহিত্যনেশায় পড়ে পড়ালেখা শিকেয় ওঠতে বেশি দেরি হয় না। এই বিভ্রমের পথে আমাকে হাতছানি দিয়ে ডাকে সাহিত্যচর্চা ও ছাত্র রাজনীতি। স্নাতক পড়াকালে ভুলে যেতে বসেছিলাম, লেখাপড়া আমার মূলকাজ, অন্য কিছু গৌণ। ক্যাস্পাসে সাহিত্য সংগঠন করা, স্থানীয় সাপ্তাহিক যুগভেরীতে ফিচার ছাপানো, দৈনিক সিলেট বাণী, দৈনিক সিলেটের ডাকে লেখা ছাপানো, সিরাজ চৌধুরী সম্পাদিত সাহিত্যপত্র সুর-এ কবিতা ছাপানো তখন নেশায় পরিণত হয়। কলেজে এবং সিলেট শহরের যারা লেখালেখি করেন, তাদের সঙ্গে জমে যায় বন্ধুত্ব। এর মধ্যে আসে কলেজের ছাত্রাবাসের ‘ছাত্রাধিনায়ক’ নির্বাচন। আমাদের কলেজে রেওয়াজ অনুযায়ী.অধিনায়ক পদে মেধাবী ছাত্ররা অগ্রাধিকার পেতেন। আমার বন্ধু জয়নাল আবেদীন (বাড়ি দক্ষিণভাগ, ইউরোপ প্রবাসী) এবং অজিত কুমার দাশ (পশ্চিম জুড়ি, আমেরিকা প্রবাসী) আমাকে নির্বাচনে প্রার্থী হওয়ার জন্য চিনে জোঁকের মতো লেগে থাকে, তারা মনে করে আমি নির্বাচিত হলে ওরাই বিজয়ী হয়। ওরা ক্ষমতায় বসে। আমি তাদের তৈরি ফাঁদে ধরা দেই। শুরু হয় রাজনীতি। পুরো তৃতীয় বর্ষ প্রিফেক্ট নির্বাচনের জন্য চলে দলবাজির ডামাডোল। আমার প্রতিদ্বন্ধী বন্ধুটিও মেধারী ছাত্র, গানও গাইতো ভাল। একই উপজেলা বড়লেখার গ্রামতলা গ্রামে তার বাড়ি। নিপাট ভদ্র, শান্ত ও নিরীহ। শাহাদাত হোসেনের পক্ষ নিলেন কিছু সিনিয়র, কিছু সিনিয়র নিলেন আমার পক্ষ। তাদের পছন্দেরও প্রার্থী যাতে নির্বাচিত হয় সে জন্য উভয় পক্ষই থাকতেন সবর, মরিয়া। প্রায়ই উত্তেজনা তৈরি হতো ছাত্রাবাসের উত্তর ব্লক এবং দক্ষিণ ব্লকের মধ্যে, দুই প্রার্থীর সমর্থকদের মধ্যে তর্কবিতর্ক, যুদ্ধদেহী মনোভাব লেগেই থাকত। সেয়ানে সেয়ানে লড়াইতে যে টানটান উত্তেজনা থাকে, ওখানেও সেই অবস্থা।

যে করেই হোক জিততে হবে এই বৈতরণী। যথাসময়ে জিতেও গেলাম। ‘অধিনায়ক’ পদে আমাকেই মনোনীত করলেন কলেজ কর্তৃপক্ষ। শুরু হয় আরেক জীবন, নেতার। আস্তধীরে ক্ষমতার স্বাদ পেতে লাগলাম। অন্তত পড়ালেখার চেয়ে অধিনায়কত্বের স্বাদ সুখকর মনে হতে লাগল। ক্যাম্পাসে আলাদা পরিচয় হয়ে গেল। বড় বড় নেতারা সারাদিন আমার রুমে পড়ে থাকতে লাগলেন। এদের কেউ কেউ এখন জাতীয় রাজনীতিতে প্রভাবশালী অবস্থানে প্রতিষ্ঠা করতে পেরেছেন নিজেকে। বাংলাদেশ ছাত্রলীগের জেলার নেতৃবৃন্দ যেমন আসতেন, তেমনি জাতীয় ছাত্রলীগসহ প্রগতিশীল অন্য সংগঠনের নেতারাও সময়ে অসময়ে হানা দিতেন আমার কক্ষ ২০১-এ। ক্যান্টিনে ফাও খেয়ে তারা অধিনায়কের নামে লিখিয়ে রাখতেন। রাতবিরেতে জমজমাট হয়ে ওঠত আমার কক্ষ। ছাত্রাবাসের সুপার অধ্যাপক আকরাম আলী তার বাসভবসে না থেকে শহরতলী টুকেরবাজারে পৈতৃক নিবাসেই বসবাস করতেন। ছাত্রাবাসে একপ্রকার অধীশ্বর হয়ে ওঠার জন্য এ ছিল মস্তসুযোগ।

দায়িত্বপালনে শিক্ষকদের প্রশ্রয় ও স্নেহ ঢের বেশি পেয়েছি সাহিত্যচর্চার কারণে। এ সময় ছাত্রাবাস বার্ষিকী ‘সংযোজন’ সম্পাদনা করি। ছাত্রাবাসে নানা সাহিত্য অনুষ্ঠান লেগে থাকতো তখন। হল সুপারেন্টেন্ট অধ্যাপক আকরাম আলী আমাকে অবাধ আস্থায় নিয়ে ইচ্ছেমতো কর্মসূচি পালনের সুযোগ করে দিয়েছিলেন।

এ সময় আসে কলেজ ছাত্র-সংসদের নির্বাচন। বাংলাদেশ ছাত্রলীগ কলেজের প্রভাবশালী ছাত্র সংগঠন। ছাত্রলীগের প্যানেলে আমাকে দেওয়া হয় ‘সাহিত্য ও বিতর্ক’ সম্পাদকের পদের প্রস্তাব। অন্যান্য পদে প্রার্থীতার জন্য জোর প্রতিদ্বন্ধিতা থাকলেও ওই পদে আমি প্রায় অনায়াসে মনোনয়ন পেলাম। প্রত্যেকটি ছাত্র সংগঠন ওই পদে সাধারণত সাহিত্য চর্চা করে এমন কাউকে বেছে নিতেন, এই রেওয়াজের মান্যতা করেছিলেন আমাদের সংগঠনও। নির্বাচন হল, আমাদের প্যানেল জিতল, কেবল জিতল না আমাদের বার্ষিকী সম্পাদক প্রার্থী বন্ধু আব্দুশ শহীদ। শুনেছি, পরবর্তীকালে তার উপজেলা জগন্নাথপুরে একটি ইউনিয়নের চেয়ারম্যান পদে নির্বাচিত হয়েছিল সে।

একসাথে দুটো দায়িত্ব পেয়ে আমার ব্যস্ততা ঢের বেড়ে গেল। ক্যাম্পাসে ‘সাহিত্য ও বিতর্ক’ সম্পাদক, ছাত্রাবাসে ‘অধিনায়ক’। এই দুটো দায়িত্ব, এরশাদ বিরোধী ছাত্র আন্দোলন অংশগ্রহণ, সাহিত্যচর্চা, সংগঠন ইত্যাদিতে ডুবে থাকায় আমার ছাত্রজীবনের অপরিমেয় ক্ষতি হল। এই ক্ষতির মধ্যে লাভ ছিল যৎসামান্য, আমি লেখালেখি, বক্ততা করা এবং সংগঠন করার একটা দীক্ষা পেলাম ওই রাজনীতিকালে। আমার গ্রাজুয়েশনের পর পড়ালেখা থেমে গেল। এই অতৃপ্তি ঘোচাতে পরবর্তী সময়ে তেজগাঁও কলেজ থেকে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে আবার পরীক্ষায় বসে রাষ্ট্রবিজ্ঞানে মাস্টার্স ডিগ্রি সম্পন্ন করেছি। এই সার্টিফিকেট আমার জীবনে কোনো কাজেই আসে না। পরিত্যক্ত কাগজের বাগাড়ে ওগুলো পড়ে আছে মুখ থুবড়ে। তবুও, একটি পিএইচডি গবেষণার পথে হাঁটছি। এটিও জমা হবে এই স্তুপে।

ধান ভানতে শীবের গীতের মতো শুনালেও এই সব বলার নেপথ্যের কথাটি হচ্ছে সাহিত্যজীবন, রাজনীতি আমার শিক্ষাজীবনের ক্ষতি করলেও তার কিছু ইতিবাচক প্রভাব রেখেছিল জীবনে। ছাত্র-রাজনীতিতে ডুবে আমার ছাত্রজীবনের পথ অমসৃণ হলেও  আমার কোনো খেদ নেই। বরং এই অধ্যায় ছিল আমার জীবনের আর্শীবাদ। ছাত্র রাজনীতি এবং লেখালখির চর্চাটা ছিল বলে এখনও আমি পড়ার অভ্যেস ধরে রেখেছি। প্রতিদিনই পড়ি। বই বন্ধুর উত্তম সংযোগ হয় জীবনে। লিখতে পারি বলেই দেশের লুপ্ত গৌরবকে পুনরুদ্ধার করতে পেরেছি। পৃথিবীতে যখন প্রতিনিয়ত ভাষা-লিপি বিলুপ্ত হওয়ার মিছিলে কাতারে শামিল হচ্ছে নানা ভাষা ও লিপি, সেই বৈরীসময়ে আমি সিলেটি নাগরীলিপি ও সাহিত্যকে নতুনভাবে উপস্থাপন করেছি দেশের মানুষের কাছে। সিলেটের ইতিহাসের হারিয়ে যাওয়া অনেক ইতিহাস গ্রন্থ পুনরায় পাঠকের হাতে তুলে দিয়েছি। মুক্তিযুদ্ধ ও ফোকলোর গবেণষায়ও প্রাচীন, লুপ্ত এবং বিরল নিদর্শনগুলো ক্রমে ক্রমে উপস্থাপনের চেষ্ঠায় সক্রিয় থাকতে পেরেছি। এই ধারার আরেকটি ফসল ‘ইটাউরি গ্রামের ইতিহাস’ গ্রন্থটি। বিশ্বাস করি, এই ছোট পরিসর গ্রন্থটি একসময় এ-অঞ্চলের মানুষের ইতিহাস রচনায় ভূমিকা রাখবে। পথ দেখাবে।

যখন ইটাউরি হাইস্কুলে অনারারি শিক্ষকতা করি (১৯৯০-৯২) তখন, সাপ্তাহিক ‘সিলেট কণ্ঠ’ পত্রিকার বড়লেখা ব্যুরো চিফ ছিলাম। সেসময় ছিল মুদ্রিত পত্রিকার যুগ। খবর মানেই সংবাদপত্র। সিলেট কণ্ঠ ছিলো সিলেটে সর্বাধিক জনপ্রিয় পত্রিকা। বড়লেখায় এর সার্কুলেশন ছিল ৫০০ কপি। সে সময় এবং পরবর্তীতে ‘মুক্তিযুদ্ধে বড়লেখা’ এবং ‘বড়লেখা : অতীত ও বর্তমান’ গ্রন্থের সাথে যুক্ত থেকে বড়লেখা সম্পর্কে জানার সুযোগ পেয়েছি। প্রকাশক হিসেবে, এই বিশ বছর সিলেটের প্রাচীন ইতিহাস-ঐতিহ্য প্রকাশ করেছি। এ বিষয়ে শতশত বই ওলটেপালটৈ দেখার সুযোগ হয়েছে আমার। এই পড়ালেখা, ইতিহাসের পরম্পরা উপলব্দি থেকে আত্মবিশ্বাসে বলীয়ান হয়ে এই কাজে ব্রতী হয়েছি।

ইটাউরি আমার জন্মভূমি। ওই গ্রামে এক সামন্ত ভূস্বামী হাজী মোশাহিদ আলীর পরিবারে আমার জন্ম। তার সহায়সম্পদে তিনি ছিলেন এলাকায় শ্রেষ্ঠত্বের অধিকারী। দাদা মোশাহিদ আলীর প্রজ্ঞা, পরিমিতিবোধ, মরমি চর্চা এবং ন্যায়পরায়নতা আমাকে অনুক্ষণ উদ্দীপ্ত করে, প্রেরণা যোগায়। আমার সম্পাদিত ‘মরমি সাধক গিয়াসউদ্দিন আহমদ গীতিসমগ্র’ গ্রন্থের উৎসর্গপত্রে আমি লিখেছি--“আমার আব্বার ‘বাজি’ ছিলেন ক্ষীণতনু, স্বল্পাহারী এবং ছোটোখাটো গড়নের মানুষ। বিপুল জমিজিরেতের অধিকারী হয়েও তিনি ছিলেন বিষয়সম্পত্তির প্রতি উদাসীন। ভাবুক এবং বৈরাগ্যস্বভাবের মানুষটি সদা মশগুল থাকতেন স্রষ্টার প্রেমে। তিনি ছিলেন শরিয়তপন্থি অধ্যাত্মবাদী। কখনও মশারি টানিয়ে ঘুমাতেন না। বলতেন, মশা মাছি তাঁকে বিরক্ত করে না। তীব্র শীতের রাত্রিতেও তিনি স্বল্প বসনে জিকির-আজগার করে ঘর্মাক্ত হতেন। বাহির বাড়ির টুঙ্গিঘরের ভেতর থেকে ভোর রাতে ভেসে আসতো তাঁর দরাজ কণ্ঠ--‘কুঞ্জিল তেরা কুঞ্জিলে জপে/ লা ইলাহা ইল্লালাহূ আরশে চমকে/ লতিফার পাগল মন করোরে সাধন/ ছয় লতিফায় পড়ইন জিগির মাবুদ নিরঞ্জন’। বালকবেলায় দেখেছি, আমাদের বাড়িতে সপ্তাহে একবার আসতেন অন্ধ ভিক্ষুক আরজ আলী। তাঁর সঙ্গে প্রতিবারই তিনি শরিয়ত-মারিফত নিয়ে আলোচনা করতেন। তখন অধ্যাত্ম সাধনার পন্থা বুঝে ওঠার বয়স হয়নি আমার। তাই, এড়িয়ে চলেছি দাদার এসব বৈঠক। দাদা যে অধ্যাত্ম সাধনার চূড়ান্ত স্তরে পৌঁছেছিলেন, প্রতি রাতেই মাশুকের সন্ধানে ‘ফানাফিল্লাহ’ হতেন, এখন বুঝতে আমার কষ্ঠ হয় না। প্রায় শতবর্ষী দাদা ১৯৮৬ সালে আমার এসএসসি পরীক্ষার কয়েকদিন পূর্বে তিনি মৃত্যুবরণ করেন। গিয়াস উদ্দিন আহমদের মতো একজন মরমি সাধকের বইটির উৎসর্গপত্র রচনাকালে আমার দাদা হাজি মোশাহিদ আলীর নামটি খুব প্রাসঙ্গিকভাবে মনে পড়ছে।”

ছবি: ইটাউরি মহিলা আলিম মাদ্রাসা সংলগ্ন মসজিদ।  স্থপতি: মোরশেদ আহমেদ

জন্মের ঋণ বড় দায়। যে পরিবারে, যে গ্রামে জন্মেছি, সেই গ্রামের একটি ইতিহাস প্রণয়নের চেষ্ঠাকে তাই জন্মের দায়শোধের একটি ক্ষুদে চেষ্ঠা হিসেবে দেখতে চেয়েছি। ইটাউরি গ্রামের ইতিহাস লেখার কাজটি আমার জন্য ছিল কঠিন এবং চ্যালেঞ্জের। এই গ্রাম সম্পর্কে খুব একটা কিছু আমি কোথাও লিখিত আকারে পাইনি। কোনো দলিল দস্তাবেজেও তার কোনো রেফারেন্স মেলেনি। গ্রামে যাঁরা মুরব্বি তাঁদের নিকটও তেমন তথ্য মেলে না। এই গ্রামের শিক্ষিত মানুষদেরও আমি সাক্ষাৎ নিয়েছি, তাঁরাও উল্লেখযোগ্য তেমন কোনো তথ্য সরবরাহ করতে পারেননি। এমত অবস্থায় নিরবলম্বন লেখকের অবস্থা সহজেই অনুমেয়।
এ গ্রন্থটির পরিসর খুব বড়ো নয়। একটি গ্রামের ইতিহাস লেখার কাজটিও খুব সংবেদনশীল। নানা সীমাবদ্ধতার ভেতর থেকে কাজটি আরো দূরুহ। শুধু ভবিষ্যতের প্রজন্মের কথা মাথায় রেখে তারপরও চেষ্ঠাটি করেছি। এখন কেউ যদি কলম না ধরে, তাহলে অতীতের মতো একালের অনেক ঘটনাও হারিয়ে যাবে কালের গহব্বরে। একালকে ভাবিকালের মানুষের সঙ্গে সেতুবন্ধনের কাজটি করা দরকার মানবসভ্যতার পরম্পরাটা রক্ষার গরজে। এ বইটির নানা তথ্য সংযোজনের জন্য, মাঠ পর্যায়ের গবেষণা পরিচালনা করা হয়েছে। ম্যাপ তৈরীতে আমাদের সহায়তা নিতে হয়েছে পেশাদার নকশাবিদের।

 

গ্রামই হচ্ছে দেশের প্রাণ। প্রতিটি গ্রামের ইতিহাস রচিত না হলে দেশের পূর্ণাঙ্গ সামাজিক ইতিহাস রচনা কখনই সম্ভব হবে না।

 

সিলেটভিউ২৪ডটকম/পিডি