ব্রিটেনের অভিবাসন আইনে বেশকিছু পরিবর্তন আসায় বাংলাদেশিসহ অবৈধভাবে প্রবেশ করা সব অ্যাসাইলাম প্রার্থীদের কঠোর ব্যবস্থার মুখোমুখি হতে হবে বলে ধারণা করছেন অভিবাসন বিশেষজ্ঞরা। এ বছরের ২৮ জুন দেশটিতে ন্যাশনালিটি অ্যান্ড বর্ডারস অ্যাক্ট-২০২২ কার্যকর হয়।

ব্রিটেনের সরকারী এক পরিসংখ্যানে দেখা যায়, ২০১৭ সালে ১ হাজার ৭১২ জন বাংলাদেশি অ্যাসাইলাম আবেদন করে। ২০১৮ সালে এই সংখ্যা ছিল ১ হাজার ২৯৪ জন এবং ২০২০ সালে ছিল ৮৭৬। আর ২০২১ সালে ব্রিটেনে আশ্রয়প্রার্থীদের আবেদন জমা পড়ে ৪৮ হাজার ৫৪০টি। যা আগের বছরের তুলনায় ৬৩ শতাংশ বেশি। করোনার বিধিনিষেধ ও ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে ব্রিটেনের হোম অফিস ২০২০ সালের জানুয়ারি থেকে সীমিত পরিসরে আবেদনের বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিচ্ছে।


বাংলাদেশসহ বিভিন্ন দেশের মানুষ রাজনৈতিক, সামাজিক ও ব্যক্তিগত কারণে নিজের জীবন বাঁচাতে ব্রিটেনে আশ্রয় প্রার্থনা করে। এই আশ্রয় প্রার্থনাকে আইনের ভাষায় বলে অ্যাসাইলাম আবেদন। কেউ অ্যাসাইলাম আবেদন করার পর হোম অফিস তথা সরকার ওই আবেদন মঞ্জুর করলে ওই ব্যক্তি ব্রিটেনে স্থায়ীভাবে বাস করতে পারে। কিন্তু হোম অফিস সম্প্রতি নতুন এক আইনে ওই আবেদন মঞ্জুরের পর আশ্রয়প্রার্থীদের দুটি ভাগে ভাগ করেছে। এর একভাগে রাখা হয়েছে অস্থায়ী আশ্রয়প্রার্থীদের। আর অন্যভাগে স্থায়ী আশ্রয়প্রার্থীদের।

নতুন এই আইনের বিষয়ে ইংল্যান্ড ও ওয়েলসের সুপ্রিম কোর্টের বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত আইনজীবী মোহাম্মদ মাহাবুবুর রহমান বলেন, গুরুত্বপূর্ণ পরিবর্তন দুটি হলো শরণার্থীদের দুই শ্রেণিতে ভাগ করা এবং স্বয়ংক্রিয় ডিপোর্টেশন নীতি, যা ব্রিটেনে বসবাসকারী বাংলাদেশি নাগরিকদের ওপর প্রভাব ফেলবে। প্রথমত, আইনটির ধারা ১২-এর অধীনে সরকার আশ্রয় দেওয়ার ক্ষেত্রে একটি নতুন নীতি তৈরি করেছে যেখানে দেশটির স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় বা হোম অফিস আশ্রয়প্রার্থীদের অস্থায়ী শরণার্থী (আড়াই বছরের জন্য) ও শরণার্থী (বিদ্যমান ব্যবস্থায় যারা পাঁচবছর পর স্থায়ী হওয়ার সুযোগ পান) এই দুটি ভাগে শ্রেণিকরণ করবে।

তিনি আরও জানান, অস্থায়ী শরণার্থীদের ১০ বছর পর্যন্ত প্রতি আড়াই বছর পর পর ভিসার মেয়াদ বাড়াতে হবে এবং এরপর তারা স্থায়ী হওয়ার সুযোগ পাবেন। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো অস্থায়ী শরণার্থীরা কমপেশনেট গ্রাউন্ডসে কারণ দর্শানো ছাড়া তাদের পরিবারের সদস্যদের স্পন্সর করতে পারবেন না। এর অর্থ হলো তারা স্বামী-স্ত্রী বা সন্তানদের ব্রিটেনে আনতে পারবেন না। তবে প্রচলিত ব্যবস্থায় শরণার্থীরা সহজেই তা করতে পারেন।

দ্বিতীয়ত, আইনের ধারা ৪০ অনুসারে বেআইনিভাবে ব্রিটেনে প্রবেশকারী বা ভিসার মেয়াদ ফুরিয়ে গেলেও অবস্থানকারী ব্যক্তিদের ডিপোর্টেশন বা দেশে ফেরত পাঠানোর ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে স্বরাষ্ট্র দপ্তরের সেক্রেটারি অব স্টেটকে। এছাড়া আইনের ধারা ৪০ এর (এফ) অংশের (এ) ও (বি) অনুযায়ী, অ্যাসাইলাম আবেদনকারীদের কেউ কোনো অপরাধে দোষী সাব্যস্ত হলে তাকে ৪ বছর পর্যন্ত কারাদণ্ড দেওয়ার অনুমোদন দেওয়া হয়েছে, চলতি বছরের ২৮ জুনের আগে ছিলো তা ৬ মাস পর্যন্ত। এছাড়া যদি কেউ ১২ মাসের বেশি সময়ের জন্য কারাদণ্ডাদেশ পান, তাহলে স্বরাষ্ট্র দপ্তরের সেক্রেটারি অব স্টেটকে অবশ্যই তাদের বিরুদ্ধে ইউকে বর্ডারস অ্যাক্ট-২০০৭ এর ধারা ৩২(৫)-এর অধীনে ডিপোর্টেশনের আদেশ দিতে হবে।

বাংলাদেশে প্রিন্টিং ও ব্রডকাস্টিং মিডিয়াসহ সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে সরকারবিরোধী খবর প্রচারের দায়ে এবং বিরোধী দলের উপর সরকারের দমন পীড়ন কার্যক্রমের কারণে অনেক বাংলাদেশি ব্রিটেনে অ্যাসাইলাম আবেদন বা আশ্রয় প্রার্থনা করেছে। সাম্প্রতিক পরিসংখ্যান অনুসারে, প্রাথমিক বিবেচনায় বাংলাদেশি অ্যাসাইলাম আবেদনকারীদের মঞ্জুরের হার ২৭ শতাংশ। যা ইরানিদের জন্য ৮০ শতাংশ এবং পাকিস্তানিদের জন্য ৪৭ শতাংশ। আগের তুলনায় বর্তমানে বাংলাদেশিদের আবেদন বেশি মঞ্জুর করা হচ্ছে বলে জানা যায়। ব্রিটেনে আশ্রয়প্রত্যাশীদের মধ্যে বাংলাদেশিরা দশম, যেখানে শীর্ষে রয়েছে ইরান।

ব্রিটেনের সরকারের পরিসংখ্যান অনুযায়ী, ২০২০ সালের সেপ্টেম্বর থেকে ২০২১ সালের সেপ্টেম্বর পর্যন্ত প্রায় এক হাজার বাংলাদেশি যুক্তরাজ্যে আশ্রয় চেয়েছে। এই সময়ের মধ্যে হোম অফিস খুব কম আবেদনের বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিয়েছে। প্রাথমিকভাবে ২৭ শতাংশ আবেদন গৃহীত হয়েছে। তবে আপিলের পর তা বাড়তে দেখা গেছে। আর ২০২২ সালের প্রথম তিন মাসে মাত্র সাত জন বাংলাদেশি হোম অফিস থেকে শরণার্থীর স্বীকৃতি পায়। এর বাইরে ৩৬ জন বাংলাদেশি আশ্রয় চাইলেও তাদের অন্যান্য ক্যাটাগরিতে ভিসা দেওয়া হয়েছে।

লন্ডনে বাংলাদেশ হাইকমিশনের একজন কর্মকর্তার সঙ্গে এ বিষয়ে কথা বললে নাম প্রকাশ না করার শর্তে তিনি জানান, একটি দেশের অভ্যন্তরীণ ইমিগ্রেশন বা অভিবাসী পলিসি নিয়ে আমরা মন্তব্য করতে পারি না। তবে যেকোনো অ্যাসাইলাম আবেদনকারী যদি হাইকমিশনে যোগাযোগ করে থাকেন, তাহলে সুনির্দিষ্টভাবে তাকে সম্ভাব্য সব ধরনের সহায়তা করা হবে।

ব্রিটেনে বসবাসরত বাংলাদেশিদের মধ্যে বৈধ বা অবৈধ সবাই দেশের রেমিট্যান্সে অবদান রাখেন। এখানকার কমিউনিটির মানুষের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, টিনেজ বয়সীসহ শত শত বাংলাদেশি অবৈধভাবে যুক্তরাজ্যে বাস করছেন এবং বাংলাদেশে প্রতি মাসে পরিবারের কাছে টাকা পাঠাচ্ছেন। যুক্তরাজ্যের অর্থনীতিতে অবদান রাখলেও এখানকার মানসম্মত জীবনযাত্রা থেকে বঞ্চিত তারা। ২০২১ সাল পর্যন্ত ব্রিটেনে বাংলাদেশি অভিবাসীর সংখ্যা ছিল প্রায় ৭ লাখ। গত বছর তারা প্রায় ১ হাজার ৫৬০ দশমিক ৪ মিলিয়ন ডলার রেমিট্যান্স পাঠান।

সিলেটভিউ২৪ডটকম/আরআই-কে