আব্দুল জলিল চৌধুরীর (১৯৩৩-১০ অক্টোবর, ২০১৯) সঙ্গে কখনও সাক্ষাৎ পরিচয়ের সুযোগ হয়নি, কিন্তু দূর থেকে তাঁর সম্পর্কে কিঞ্চিৎ জানতাম। জানতাম, সিলেটি নাগরীলিপি তিনি চর্চা করেন এবং সিলেটি নাগরীলিপি হরফে কিছু কিছু বইপত্র তিনি প্রকাশকও করেছেন। তাঁর উদ্যোগে সিলেটি নাগরী হরফের কম্পিউটার ফন্ট (১৯৯৪) তৈরি হয়েছে। জলিল চৌধুরীর বইপত্রে যে ফন্ট ব্যবহার হয়, যাকে ‘এসএমএস নাগরী ফন্ট’হিসেবে নামকরণ করেছেন তিনি, সেই ফন্টটির ডিজাইনারের নামটিও জানা যায় তাঁর ‘রং ঢং কিচ্ছা’বইটির সূত্রে। এই বইয়ের উৎসর্গপত্রে তিনি লিখেছেন, ‘দুইজন নিষ্ঠাবান মহৎ মানুষের কঠোর পরিশ্রমে ১৯৯৩ইং-১৯৯৪ ইং-তে এসএমএস ছিলটি ফন্ট সম্প্রসারিত হইয়াছিল। যাহার ফল এই সকল পুস্তিকার প্রকাশ। তাহাদের নিকট কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন ও তাহাদের দীর্ঘায়ূ ও উজ্জ্বল ভবিষ্যত কামনা করিয়া খয়রুল আখতার চৌধূরী ও ফয়জুল আখতার চৌধূরীকে।’যদিও তাঁর ফন্টটি এ পর্যন্ত যে তিনটি ফন্ট তৈরি হয়েছে তার মধ্যে সবচেয়ে বেঢপ এবং নাগরীলিপির বর্ণের সঙ্গে কম সঙ্গতিপূর্ণ ফন্ট হিসেবে আমার কাছে প্রতীয়মান হয়েছে। ব্রিটিশ নাগরিক ড. সু লয়েডের নাগরী ফন্ট ‘সুরমা’ প্রায় নিকটবর্তী সময়ে তৈরি। ২০০৭ সালে ইনজিনিয়ার মোঃ আব্দুল মান্নান ‘ফুল নাগরী’নামে ফন্ট ডিজাইন করেন। এই ফন্টটি উৎস প্রকাশন কর্তৃক প্রকাশিত নাগরীলিপির বইপত্রে ব্যবহার হওয়ার সুবাদে ব্যাপক পরিচিতি পেয়েছে। এই ফন্ট ডিজাইনের সময় নাগরীলিপি বিশেষজ্ঞদের মতামত গ্রহণ করা হয়েছে। নাগরীলিপি বিষয়ে প্রথম এবং সমাদৃত পিএইচডি থিসিসের গবেষক ড. গোলাম কাদিরের এ ফন্টটিকে আদর্শ হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়ার পরই উৎস প্রকাশন এটি গ্রহণ করেছে।

ছবিতে আব্দুল জলিল চৌধুরী

আব্দুল জলিল সিলেট জেলার গোলাপগঞ্জ উপজেলার ফুলবাড়ি গ্রামে ১৯৩৩ সালে জন্মগ্রহণ করেন। পিতা মুহিবুস সামাদ চৌধুরী, মা আবেদা খাতুন চৌধুরী। সিলেটের এমসি কলেজে ইন্টারমিডিয়েট অধ্যয়ন সমাপন্তে তিনি যুক্তরাজ্যে চলে যান, সেখানে উচ্চশিক্ষা সম্পন্ন করে জীবনের ৫০ বছরের বেশি সময় অতিবাহিত হওয়ার পর সিলেটের সঙ্গে তৈরি হয় তাঁর নতুন সেতুবন্ধন।


জলিল চৌধুরী বিলেতে অভিবাসন নিলেও দেশের সঙ্গে ছিল তাঁর নিবিড় সম্পর্কযোগ। নাগরীলিপিতে আসক্তি ছিল রক্তের উত্তরাধিকার সূত্রে। পূর্বপুরুষ আব্দুল ওয়াহাব চৌধুরী ছিলেন মশহুর মরমি সাধক, তিনি তাঁর গান পয়ার ইত্যাদি রচনা করেছেন সিলেটি নাগরীতে। আব্দুল ওয়াহাব চৌধুরীর পুত্র মুহিবুস সামাদ চৌধুরী ছিলেন আব্দুল জলিল চৌধুরীর পিতা। এই আধ্যাত্মিক সাধকের শিষ্য ছিলেন শীতালং ফকিরসহ বহু গুণী সাধক। একদা ফুলবাড়ি পরিণত ওঠেছিল সুফিবাদের তীর্থভূমিতে। এর পেছনে ছিল ওয়াহাব চৌধুরীর প্রভাব। ফুলবাড়ি মাদ্রাসাকে কেন্দ্র করে প্রেমে ভালোবাসায় স্রষ্ঠার নৈকট্যলাভের যে সাধনপন্থা সেই পথের অনুসারীদের পদভারে মুখরিত ছিল ফুলবাড়ি এবং তাদের সকলের গুরু ছিলেন মহান সাধক আব্দুল ওয়াহাব চৌধুরী। এই সাধকের উত্তরসূরী আব্দুল জলিল চৌধুরীর ভেতরে নাগরীলিপির প্রতি অনুরাগ থাকাটা ছিল তাই খুবই সংগত। তাঁর ভাষ্যেও এর স্বীকৃতি মেলে। তিনি তাঁর ‘ইছলামের ভিত্তি’ গ্রন্থের উৎসর্গপত্রে লিখেছেন, ‘আমার শিক্ষা সংস্কৃতির উৎস শাহ ছুফি আব্দুল ওহাব চৌধূরীর উদ্দেশ্যে উৎসর্গিত’।

জলিল চৌধুরীর শৈশব তারুণ্য কেটেছে বাংলাদেশে। এ সময় তাঁর পরিবারে মা চাচিদের, পাড়াপড়শিদের নাগরী পুঁথি পাঠ করতে দেখেছেন তিনি। পরিবারেও ছিল রাগ ওয়াবি চর্চা। তিনি লিখেছেন, ‘ছেলেবেলা থেকে এরুপ অনুষ্ঠান দেখে এসেছি ও বাড়ীতে করিমগঞ্জ অঞ্চলের লোক কণ্ঠে শীতালং শাহ এর গীতি শোনে বিনিদ্র রজনী কেটে বিভোর হয়েছি।’চম্পূ চয়নের দ্বিতীয় খণ্ডের ভূমিকায় তিনি এ বিষয়ে লিখেছেন-‘ছেলেবেলা হইতেই ছিলটি ভাষা লিখাপড়া এবং ছিলটি ভাষায় পুঁথিপাঠ শুনার আগ্রহ ছিল। গায়ের বুড়িরা শীতের সকালবেলা রুদে বসে পুঁথি পড়িত আর মুগরীবের পরে গায়ের গৃহস্থর একত্র হইয়া গাজীর গীত বা পুঁথি আবৃত্তি শুনে শুনে বৎসরের ফসল হইতে তৈরি পিঠা খাওয়ার প্রচলন ছিল।...অবসর পাইলে গীত শুনিতে যাইতাম আর আমাদের বাড়ীতে ও ধারের বাড়ীতে এক বুড়ীর পুঁথি ছিল। কোন কোন সময় তাহার পুঁথিও পড়িতাম।’ এই দেখেই নাগরীলিপির পুথি সাহিত্যের প্রতি ভালোবাসা। বিলেতে চাকরি এবং ব্যবসা জীবনে আর্থিক সচ্ছলতা লাভ করে তিনি দেশে ফিরে সমাজসেবা, সাহিত্য ও শিক্ষাসেবায় মনোনিবেশ করেন। তাঁর হাতে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান এবং তিনি বহু শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের পৃষ্টপোষক। এ বিষয়ে বিস্তারিত আলোচনা এখানে প্রাসঙ্গিক নয়, কারণ এই প্রবন্ধে তাঁর সাহিত্য-কীর্তি এবং সাহিত্যসেবা বিষয়ে যে ভূমিকা এর অন্বেষণই লক্ষ্য।

পূর্বপুরুষদের মতো জলিল চৌধুরীও সুফি ধারার অনুসারী ছিলেন।
তিনি লিখেছেন- ‘সদা কেন ভাবনা এত; কর নির্ভর আল্লাহর
        পীর মুর্শীদের আর্শিবাদে হইবে ভব পার’

তাঁর প্রকাশিত গ্রন্থের সংখ্যা ২০টি। তিনি এসব বইপত্র মানুষের মধ্যে বিনামূল্যে বিতরণ করেছেন। তাঁর উদ্দেশ্য ছিল মানুষকে ঐতিহ্য সচেতন করা এবং ধর্মীয় মূল্যবোধে উজ্জীবিত করে পরকালের জন্য প্রস্তুতিতে সহায়তা করা।

আব্দুল জলিল চৌধুরীর প্রকাশিত বইপত্রকে বিষয়বস্তুর দিক থেকে মোটাদাগে তিনভাগে ভাগ করা যেতে পারে। বৃহদাংশ সিলেটি নাগরীলিপির পাণ্ডুলিপি উপস্থাপন, একাংশ ধর্মীয় বিষয়ক বই, অবশিষ্টাংশ তাঁর কবিতা ও রম্যরচনা। তার বইকে ‘বহূভাষি’গ্রন্থ নামকরণ করে তিনি প্রতিটি বইতে সিলেটি নাগরীলিপি, বাংলা, ইংরেজি ও আরবী ভাষা ব্যবহার করেছেন। দু-একটি বইতে এর ব্যত্যয় দেখা যায়।

সিলেটি নাগরীলিপি শিক্ষা বিষয়ক বই ‘ছিলটি পয়লা কিতাব’তাঁর একটি গ্রন্থ। ‘চম্পূ চয়ন’চার খণ্ডে প্রকাশিত হয়েছে, প্রকাশকাল যথাক্রমে ২০০৩, ২০০৫, ২০১২, ২০১৭। পৃষ্ঠা সংখ্যা ২৬৪, ২৭০, ৩০৮, ২৮০। চারটি গ্রন্থই সংকলিত, গ্রন্থের বিষয় গান ও কবিতা। নাগরীলিপিতে রচিত কয়েকজন মহাজনের গান ও বয়ান উপস্থাপিত হয়েছে। তবে বৃহদাংশ জুড়ে রয়েছে গান। শীতালং ফকির, দীন ভবানন্দ, আব্দুল ওয়াহাব চৌধূরীর গান এবং বয়ান সংকলিত হয়েছে হাফিজ আমিন উদ্দিন, বড় জঙ্গনামা, আব্দুল ওয়াহাব চৌধূরীর ভেদকায়া এবং মুন্সী সাদেক আলীর মহব্বত নামা এবং হালতুন্নবী থেকে। জলিল চৌধুরী নিজের কিছু রচনা চম্পূ চয়নে সংকলন করেছেন। এই চার খণ্ডে মূলত উপস্থাপিত টেক্সট নাগরীলিপিতে, তবে বাংলালিপিও ব্যবহার করেছেন স্থানে স্থানে। চম্পু ভারতীয় সাহিত্যের একটি ধারা, খৃস্টিয় ষষ্ট শতাব্দীর আগেও এর প্রচলন বলে অনুমান। গদ্য এবং পদ্যের সংমিশ্রণে যে গ্রন্থ তাকে চম্পু গ্রন্থ বলা হয়।

বিশ্বনাথ কবিরাজের মতে, ‘গদ্যপদ্যময়ী ক্বচিৎ চম্পুরিত্যভিধীয়তে’ (সূত্র: বিশ্বনাথ কবিরাজের সাহিত্যদর্পণ)। ষষ্ট শতাব্দীর পর কয়েশ শতাব্দী এর প্রচলন থাকলেও পরবর্তীতে এই ধারার বিলোপ ঘটে। তবে সিলেটি নাগরীলিপির পুঁথি সাহিত্যে (সপ্তদশ শতাব্দী থেকে বিংশ শতাব্দী) এর প্রচলন ছিল। সিলেটি নাগরীলিপিতে যে চম্পুধারা বিদ্যমান ছিল সেটি একটু ভিন্ন ধাঁচের। এই লিপিতে রচিত সাহিত্যে বয়ান বা আলোচনা ছিল পয়ারে, রাগ বা গানও থাকত গীতিকাব্যের আদলে।

জলিল চৌধুরীর বিশেষ মনোযোগ পেয়েছেন সিলেটি নাগরীলিপির এক মহান সাধক শীতালং শাহ। শীতালং-এর মতো বড়ো মাপের সুফিসাধক বাংলা অঞ্চলে খুব বেশি নেই। তিনি কামেল পীর ছিলেন। তাঁর সমাধি রয়েছে সিলেটের জকিগঞ্জ উপজেলায়। এই সাধকের মশকিল তরান পুঁথিটি সুফি বিষয়ক এক অনন্য এক পাণ্ডুলিপি। এই পাণ্ডুলিপি বিশালায়তনের। পাণ্ডুলিপিতে বয়ান এবং গান দুটোই রয়েছে। তাঁর গানে মুগ্ধ হয়েছেন কথাসাহিত্যিক হুমায়ূন আহমেদ। তিনি তাঁর ‘ঘেটু পুত্র কমলা’ সিনেমায় শীতালং ফকিরের ‘শুয়া উড়িল উড়িল জীবেরও জীবন, শুয়া উড়িলরে’গানটি ব্যবহার করেছেন। শীতালং এর পুঁথির সংখ্যা একাধিক বলে আমরা জেনেছি। এই প্রবন্ধের লেখক নিজে ব্যাপক অনুসন্ধান করেও তাঁর মশকিল তরান ব্যতীত অন্য কোনও পুঁথির খোঁজ পাননি। জলিল চৌধুরীর উপস্থাপনায় ২০১৮ সালের ডিসেম্বর মাসে মশকিল তরান-এর প্রথম খণ্ড প্রকাশিত হয়েছে। প্রকাশক যথারীতি ট্রাস্ট শাহ মহিবুস সামাদ চৌধুরী। পৃষ্ঠা সংখ্যা ২৩৪। এ গ্রন্থে নাগরীলিপিতে শীতালং ফকিরের পাণ্ডুলিপি উপস্থাপন করেছেন গ্রন্থকার। বাংলা হরফে সংক্ষিপ্ত প্রারম্ভিকা রয়েছে। গ্রন্থে দু-এক স্থানে সামান্য বাংলায় লেখা রয়েছে। গ্রন্থে মশকিল তরানের একাংশ উপস্থাপিত হয়েছে। এর দ্বিতীয় খণ্ডে মশকিল তরান সম্পন্ন হয়েছে। দ্বিতীয় খণ্ডে কোন প্রিন্টার্স লাইন নেই। এই খণ্ডের পৃষ্ঠা বিন্যাস হয়েছে এভাবে, ২৩৫-৪৭৬। একই রকমের প্রচ্ছদ, কাগজ, বাঁধাই ইত্যাদি দেখে আমাদের ধারণা গ্রন্থের দুটো খণ্ডই একই সময়ে প্রকাশিত। গ্রন্থটির আকার আকৃতি যেন খুব বড় না হয়, ব্যবহারে পাঠকের যেনো স্বস্তি হয়, এটা বিবেচনা ছাড়া অন্য কোনও কারণে একটি গ্রন্থকে দু’খণ্ডে মুদ্রণের যুক্তি থাকতে পারে না। একটি কথা বলা দরকার, জলিল চৌধুরী বই প্রকাশে প্রচলিত রীতি কাঠামোকে খুব মান্য করেছেন এটা মনে হয়নি তাঁর প্রকাশিত বইপত্র দেখে। প্রকাশনা রীতিনীতি, শৈলী অমান্য হয়েছে তাঁর বইপত্রে। স্থানে স্থানে তিনি স্বাধীনতা গ্রহণ করে ইচ্ছেমতো প্রিন্টার্স লাইন, বইয়ের বিষয় বিন্যাস, সেটিং ইত্যাদি সেরেছেন। মুদ্রণ প্রমাদ অমার্জনীয় পর্যায়ে, পাঠকের চোখে প্র্রশান্তি বিঘ্নিত হয় বইগুলো ব্যাপক বানান ভুলে। খুব সাধারণ মানের বানানও ভ্রান্তির কবলে পড়েছে। ‘তুমি’ শব্দটির বানান ‘তোমি’ লিখলে প্রকাশকের বা লেখকের ব্যর্থতা প্রকট হয়ে ওঠে। বইগুলো মুদ্রণে লক্ষ লক্ষ টাকা ব্যয় হলেও পেশাদার মুদ্রক বা প্রুফরিডার অথবা গ্রন্থ সম্পাদকের শরনাপন্ন না হওয়ার তাঁর বইগুলো নিখুঁত হয়নি। পৃষ্ঠাসজ্জায় খামখেয়ালিপনার কারণে বইগুলো পাঠককে স্বস্তি দেয় না।

সিলেটি নাগরীলিপি সাধকদের গুরু এবং পীর আব্দুল ওয়াহেদ চৌধুরী সিলেটের গোলাপগঞ্জ উপজেলার ফুলবাড়িতে জন্মগ্রহণকারী এক অবিস্মরণীয় সুফি-ব্যক্তিত্ব। তাঁর দুটো পুঁথি উপস্থাপন করেছেন আব্দুল জলিল চৌধুরী, ‘ভেদ কায়া’এবং ‘হাসর তরান’। দুটো গ্রন্থই ২০০১ সালে প্রকাশিত হয়ে দ্বিতীয় সংস্করণ প্রকাশিত হয়েছে ২০১৮। প্রকাশক ট্রাস্ট শাহ মহিবুস সামাদ চৌধুরী। ভেদ কায়ার পৃষ্ঠা সংখ্যা ১৩৬, হাসর তরানের ৭২। জলিল চৌধুরীর গ্রন্থে নাগরীলিপি থেকে লিপ্যন্তরের ক্ষেত্রে রীতিনীতি উপেক্ষিত হয়েছে প্রায়শই। ভেদ কায়া এবং হাসর তরান গ্রন্থে ভূমিকা ছাড়া বাংলালিপির তেমন ব্যবহার নেই। বইয়ের মূল টেক্সট সিলেটি নাগরীলিপি, তবে দু-এক স্থানে অল্পস্বল্প বাংলাও ব্যবহার রয়েছে। জলিল চৌধুরীর সকল প্রকাশনায় প্রিন্টার্স লাইন ইংরেজিতে ছাপা হয়েছে। এই বইগুলোর প্রিন্টার্স লাইন একই সিলসিলা বা পরম্পরাকে মান্য করেছে।

আব্দুল জলিল চৌধুরীর রচনাবলিতে ইসলামি কয়েকটি বই রয়েছে। তিনি একটি সাধক পরিবারের সন্তান। যে পরিবারকে ঘিরে ধর্ম চর্চার একটি বৃত্ত তৈরি হয়েছিল তাঁর এলাকায়। এই পরম্পরার উত্তরপুরুষের হাতে প্রণীত হবে ইসলামের নানা পালনীয় বিষয়ে গ্রন্থ, এটা খুব অবধারিত বিষয়। ‘ইছলামের ভিত্তি’তাঁর এ রকম একটি গ্রন্থ। প্রকাশকাল ২০০৫, পৃষ্ঠা সংখ্যা ৪৪৬। বইটির প্রচ্ছদ পৃষ্ঠায় বাংলার সঙ্গে সমান গুরুত্ব দিয়ে বইটির নাম যথাক্রমে নাগরী এবং ইংরেজিতে দেওয়া আছে। সূচি অনেক দীর্ঘ। ইমান ও ছালাত এর অধীনে উপশিরোনাম ১৭ টি, ছাউম ও যাকাত এর অধীনে উপশিরোনাম ৩৯, হজ্জ্ব এর অধীনে উপশিরোনাম ৫৬টি, ধর্ম্ম/কর্ম এই কয়টি বিভাগের অধীনে উপশিরোনামায় রয়েছে ১৯টি। বইটির ভাষা মূলত তিনটি; বাংলা, আরবি এবং ইংরেজি, তবে লিপির সংখ্যা ৪টি। এগুলো হলো বাংলা, সিলেটি নাগরী, আরবি এবং ইংরেজি। বাংলা লেখার ক্ষেত্রে তিনি বাংলা এবং সিলেটি নাগরীলিপির ব্যবহার করেছেন সমান্তরালে।

লেখকের একটি গ্রন্থ ‘হজ্জ্ব’। প্রকাশিত হয়েছে ২০০১ সালের ফেব্রয়ারি মাসে। পৃষ্ঠা সংখ্যা ২৫২। প্রকাশক ট্রাস্ট শাহ মহিবুস সামাদ চৌধুরী। বইটির টেক্সট সিলেটি নাগরীলিপি, বাংলা, ইংরেজি আরবিতে লেখা। এ ধরনের বইকে লেখক ‘বহুভাষি’গ্রন্থ হিসেবে আখ্যাত করেছেন। ‘ছওউম ও যাকাত’, ‘ইমান ও ছালাত’গ্রন্থ লেখার পরে ইসলামের অবশ্য কর্তব্য ‘ফরজ’বিষয় হিসেবে তিনি গ্রন্থটি লিখতে প্রয়াসী হয়েছেন বলে ভূমিকায় জানিয়েছেন। হজ্ব বিষয়ক নানাবিদ জরুরি আলোচনা অন্তে লেখকের কয়েকটি কবিতা ছাপা হয়েছে বইটিতে।
হজ্ব কবিতায় তিনি লিখেছেন-
আমি যাই, যাই সেই মক্কার পথে;
বিধাতা তোমি ডাকিয়াছ, তাই দাওয়াত লইয়া সাথে।
কত দূর, আর কতদূর কা’বার ঘর;
জাহাজে বসিয়া উড়িতেছি প্রাণ করিছে চিৎকার।
সেথায় চলে গেছে আমার প্রাণ;
শরীরটা পিছনে ফেলে গেছে হইতে বিরান। (হজ্জ্ব, পৃষ্ঠা ২৪৬)

‘দোয়া ও দাওয়া’ আব্দুল জলিল চৌধুরীর একটি ‘বহুভাষি’গ্রন্থ। এই গ্রন্থের বিষয়বস্তু ধর্মীয় রীতির নানাবিদ দোয়ার সংকলন। গ্রন্থটি ২০০২ সালে প্রকাশিত হয়েছে। প্রকাশক ট্রাস্ট শাহ মহিবুস সামাদ চৌধুরী। পৃষ্ঠা সংখ্যা ২৭৬। গ্রন্থের শেষে কয়েকটি পাতা জুড়ে রয়েছে তাবিজকবচে ব্যবহার হয় এমন কিছু লেখা।

২০০৬ সালের জুলাই মাসে ‘ট্রাস্ট শাহ মহিবুস সামাদ চৌধুরী’প্রকাশ করে ‘হজ্জ্ব ও উমরাহ নির্দেশক’। পৃষ্ঠা সংখ্যা ৮৪। গ্রন্থটি ‘দ্বিভাষি’। বাংলার পাশাপাশি রয়েছে আরবি। বিশেষত দোয়া ও সূরা ইত্যাদি আরবিতে লেখা হয়েছে। গ্রন্থটির শেষে পরিশিষ্ট অংশে ৪টি কবিতা স্থান পেয়েছে। লেখক জীবনের শেষের দিকে প্রতিবছরই হজ্জ্বব্রত পালন করেছেন। হজ্জ্বপালনকারীদের সুবিধার্থে এই গ্রন্থ প্রণয়ন করেছেন প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতার আলোকে। গ্রন্থে হজ্বের প্রয়োজনীয় বিষয়ে নির্দেশনা এবং রীতিনীতি ইত্যাদি বর্ণনা করেছেন খুব সাবলীলভাবে।

ত্রিভাষিক গ্রন্থ ‘তাওয়াফ ও ছা’ই’ প্রকাশিত হয় ২০০১ সালে, অক্টোবর মাসে। ক্ষীণকায় এই গ্রন্থের পৃষ্ঠা সংখ্যা ৭৪। গ্রন্থে তিনটি ভাষা ব্যবহার হয়েছে। বাংলা, আরবি এবং ইংরেজি। ইংরেজি ব্যবহারের পেছনে  বিলেতে বেড়ে ওঠা বাঙালি ছেলেমেয়েদের প্রয়োজনের বিষয়টি লেখক বিবেচনায় নিয়েছেন, এমন তথ্য তার বইয়ের ভূমিকায় ব্যক্ত হয়েছে। গ্রন্থটি প্রকাশ করেছে ‘ট্রাস্ট শাহ মহিবুস সামাদ চৌধুরী’। গ্রন্থটির শেষে পরিশিষ্ট অংশে ৪টি কবিতা স্থান পেয়েছে, যা তার অন্য্য কয়েকটি বইতেও গ্রন্থভুক্ত করেছেন আব্দুল জলিল চৌধুরী। এই গ্রন্থে আল্লাহর ঘর বলে খ্যাত বায়তুল্লাহ শরীফ তওয়াফ করার ধর্মীয় রীতিনীতি তুলে ধরেছেন বিশদভাবে।

পুঁথি সাহিত্য সম্পাদনা এবং উপস্থাপনের কাজটিতে মজে জলিল চৌধুরী কবিতা রচনায় আগ্রহী হয়ে ওঠেন। তাঁর কাব্য চর্চার সংকলন ‘জলিল চৌধুরীর হ,য,ব,র,ল কবিতা সমূহ’, প্রকাশকাল ডিসেম্বর ২০০৮। যথাথই নাম দিয়েছেন তিনি হযবরল কবিতা, এই গ্রন্থভুক্ত কবিতাগুলো কবিতার ব্যাকরণ, ছন্দ মেনে লেখা হয়নি। চারণ কবিদের মতো ভাবে মজে তিনি লিখেছেন কবিতা। কবিতা গ্রন্থটির পরিসর বিস্তৃত, ৩০৫ পৃষ্ঠা। গ্রন্থে মোট ৩২৮ কবিতা স্থান পেয়েছে। কবিতার বিষয় বৈচিত্র্যপূর্ণ। তবে অর্ধেকের  অধিক কবিতা সৃষ্ঠিকর্তার প্রতি নিবেদিত। কিছু কবিতায় মরমি সুর খুব পরিস্কারভাবে পরিস্ফূট। উদাহরণ দেওয়া যাক-
নিকুঞ্জ মন্দিরেকে বাজায় শ্যামেরও বাশরী;
শিহরিয়া ওঠে কোন প্রাণ মুনিয়া বাশিরর সুর; (পৃষ্ঠা ৪১, জীবন মধ্যাহ্ন)

অন্য আরেকটি কবিতা-
লহ শ্রদ্ধাঞ্জলি জাগো অন্তরে মম;
মাহবুবে দারওয়ান তোমি মুরশীদ মম;
ঝড় তুফানে কাণ্ডারী তোমি;
মারিফতের গুরু। (পৃষ্ঠা ৩, মুরশীদ)

‘রংগ ঢংগ কিচ্ছা’ জলিল চৌধুরীর রম্যধাচের একটি গ্রন্থ। বাংলা, নাগরী এবং ইংরেজি অক্ষরে প্রচ্ছদ পৃষ্ঠায় বইটির নামাঙ্কিত হয়েছে। এর প্রকাশকাল ২০০০, প্রকাশক ট্রাস্ট শাহ মহিবুস সামাদ চৌধুরী, পৃষ্ঠা সংখ্যা ১৪৪। ৩৬টি শিরোনামে তিনি হাস্য পরিহাসের মাধ্যমে নানা বিষয়ের অবতারণা করেছেন। পুরো বইটি নাগরীলিপিতে লেখা, মাঝেমধ্যে বিষয়ের শিরোনামের নীচে বাংলা লিপিতেও সেই শিরোনাম লিপিবদ্ধ করেছেন লেখক।

‘অদৃষ্ঠ পরীক্ষা’লেখকের অন্য আরেকটি প্রকাশনা। বইটির বিষয়বস্তু এবং প্রকাশনার উদ্দেশ্য তাঁর এক পৃষ্ঠার ভূমিকা থেকে জানা যায়, ‘এই পুস্তিকা মূলতঃ “ডয়েচ”(জার্মান) ভাষায় লিখিত। ইহা বিভিন্ন ভাষায় অনুবাদিত হইয়াছে। সন ১৩২০ সালে শ্রী অধর চক্রবর্তী কর্তৃক কলিকাতা হইতে ইহা ইংরাজী হইতে বঙ্গ ভাষায় অনুবাদিত ও প্রকাশিত হয়। কথিত আছে মহাবীর সম্রাট নেপোলিয়ান বোনাপার্ট এর ইহার উপর এরূপ বিশ্বাস ছিল যে তিনি অধিকাংশ সময়ে বহুবিধ কার্য্য এই পুস্তকের মতানুসারে সম্পন্ন করিতেন এবং তাহারই “দুর্লভ পবিত্র সম্পত্তি”মধ্য হইতে ইহা প্রাপ্ত হইয়াছিল।’

জ্যোতিষ শাস্ত্রেও প্রতি মানুষের বিপুল আগ্রহের পরিপেক্ষিতে তিনি এই গ্রন্থটি উপস্থাপন করেছেন। তিনি লিখেছেন, ‘মানব জীবনের এক অধ্যায়ে সকল নরনারীই ভবিষ্যত জানিতে আগ্রহী হইয়া পড়েন এবং বয়োবৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে তাহা বাতাসে ভাসিয়া যায়। ইহা প্রকাশ করার উদ্দেশ্য তাহাদের প্রমোদ প্রদান ও অজানার অন্বেষনে মানুষের খুজে পাওয়ার শক্তির এক দিক সম্মুখে ধরে তুলা মাত্র।’

অদৃষ্ঠ পরীক্ষা ক্ষুদ্র পরিসর গ্রন্থ, একে পুস্তিকা বলাই শ্রেয়। পৃষ্ঠা সংখ্যা ৪২, প্রকাশকাল আগস্ট ২০০৩, প্রকাশক ট্রাস্ট শাহ মহিবুস সামাদ চৌধুরী। বইটিতে ভাগ্য গণনা ও ভাগ্যচক্রের নানা বিবরণ রয়েছে। এই বইটি লেখক নিজে অনুবাদ করেছেন কিনা, সে ব্যাপারে কোনও তথ্য নেই। অনুমান করা যায়, শ্রী অধর চক্রবর্তী অনূদিত বইটিকে উপস্থাপন করেছেন তিনি। জলিল চৌধুরীর সাহিত্যকর্ম ও প্রকাশনাগুলো বিশ্লেষণ করে উপান্তে একটি বিষয়ে আমাদের মতামত হচ্ছে, তিনি বহু শ্রম ও অর্থ ব্যয়ে আজীবন যে সাধনা করেছেন, তাতে যদি সম্পাদনা ও প্রকাশনার নিয়ম রীতি প্রতিপালিত হত, তাহলে তার কাজগুলো আরও বেশি গ্রহণযোগ্য হত।

আব্দুল জলিল চৌধুরীর বইপত্র উপস্থাপনে কিছু সীমাবদ্ধতা ছিল, এটি যেমন সত্য তার চেয়ে বড় কথা হচ্ছে আমাদের দেশের একটি বিলুপ্ত ঐতিহ্য সিলেটি নাগরীলিপি প্রসারে তাঁর অনন্য ভূমিকা। তাঁর নাগরীলিপি প্রেম নিখাঁদ। তিনি গাঁটের কড়ি ব্যয় করে নাগরীলিপিতে বই প্রকাশ করেছেন। আগ্রহীদের মধ্যে বিনামূল্যে প্রচার করেছেন। এই কাজের মূল্য অতুলনীয়। নাগরীলিপি লুপ্ত হয়ে যাওয়ার পর নাগরীলিপি চর্চা অব্যাহত রেখেছিলেন জলিল চৌধুরীর মতো কিছু মানুষ। যাদের পথ ধরে ২০০৯ সালে এই প্রবন্ধকার স্বপ্ন দেখেছিলেন নাগরীলিপি ও সাহিত্যের নবজীবনের। এই প্রবন্ধকারের পরিচালিত জাতীয় প্রকাশনা প্রতিষ্ঠান উৎস প্রকাশন হয়েছিল এই স্বপ্নজয়ে সহযোগী। এক যুগের প্রচেষ্ঠায় সিলেটি নাগরীলিপির নবজাগরণ হয়েছে, দেশে বিদেশে সিলেটি নাগরীলিপি ও তার সাহিত্য পাঠ, চর্চা শুরু হয়েছে। এই সময়ে আব্দুল জলিল চৌধুরীর ভূমিকা মূল্যায়নের দাবি আরও প্রাসঙ্গিক হয়ে ওঠে।

তথ্যসূত্র নির্দেশ :
১.রং ঢং কিচ্ছা, আব্দুল জলিল চৌধুরী, প্রকাশকাল ২০০০, প্রকাশক ট্রাস্ট শাহ মহিবুস সামাদ চৌধুরী
২.চম্পূ চয়ন, আব্দুল জলিল চৌধুরী ১ম খণ্ড, পৃষ্টা সংখ্যা : অনামাঙ্কিত, প্রকাশকাল ২০০৫, প্রকাশক- ট্রাস্ট শাহ মহিবুস সামাদ চৌধুরী
৩.চম্পূ চয়ন, আব্দুল জলিল চৌধুরী ৩য় খণ্ড, পৃঠা সংখ্যা : ৪, প্রকাশকাল ২০১২, প্রকাশক- ট্রাস্ট শাহ মহিবুস সামাদ চৌধুরী।’
৪.সাহিত্যদর্পণ বিশ্বনাথ কবিরাজ।

লেখক: মোস্তফা সেলিম, সিলেটি নাগরীলিপি নবজীবনের পুরোধা। মুক্তিযুদ্ধ ও ফোকলোর গবেষক। প্রকাশিত গ্রন্থ ৪০।