বাংলাদেশের স্বাধীনতা অর্জন হয়েছে পঞ্চাশ বছর পেরিয়ে গেছে। এখন একবিংশ শতাব্দীর ত্রিশের দশকের পথ পাড়ি দিচ্ছে স্বাধীন বাংলাদেশ। স্বাধীন বাংলাদেশ হয়ে উঠার আগের চিত্র ছিলো পাকিস্তানি শাসক গোষ্ঠী ও শোষক গোষ্ঠী দ্বারা বাঙালি শোষণ ও নির্যাতন। তখন পাকিস্তানে গণতন্ত্র ছিলো সম্পূর্ণ উপেক্ষিত। এখনও পাকিস্তানে গণতন্ত্র নাই, সেটা প্রতিদিন খবরের কাগজে, অনলাইন নিউজ মিডিয়ায় এবং বিভিন্ন টেলিভিশন চ্যানেলে প্রচার হওয়া পাকিস্তানের রাজনৈতিক অঙ্গনের সংবাদ থেকে সহজে বুঝতে পারা যায়। বাংলাদেশের কি অবস্থা? হ্যাঁ, বাংলাদেশ এখন পরদেশী বা পরজাতি দ্বারা সরাসরি আর শাসিত হচ্ছে না। তবে বাঙালি জাতি কি শোষণ মুক্ত সমাজ পেয়েছে? এখানে গণতন্ত্রের সংগ্রাম চলছেই। 

 


পঞ্চাশ বছর বয়সী বাংলাদেশ এখন প্রযুক্তিতে ও অবকাঠামো উন্নয়নে উল্লেখযোগ্য পথ পাড়ি দিচ্ছে। এখানে জেলায় জেলায় মেডিক্যাল কলেজ হয়েছে, বিশ্ববিদ্যালয় হয়েছে এবং হচ্ছে। রাজধানী ঢাকায় মেট্রোরেল, এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে এবং শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরকে থাইল্যান্ডের সুবর্ণ ভূমি বিমান বন্দরের মতো করে এমন ভাবে সাজানো হয়েছে বিশ্বের উন্নত দেশের বিমানবন্দরের মতো সুবিধা যাত্রী সাধারণ এখানে পাবে। চট্টগ্রামে কর্ণফুলী টানেল, ঢাকা থেকে কক্সবাজার দ্রুত গতিতে ট্রেনে যাওয়া আসার সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে। সিলেটে মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয় হয়েছে। তা-সত্বে-ও আমাদের মৌলিক অধিকারের বিষয় নিয়ে যে আন্দোলন ১৯৭১ খ্রীষ্টিয় সালের সদ্য-স্বাধীন বাংলাদেশের জনগণের ছিলো তা কিন্তু এখনও চলমান। এখানে ক্ষুধার্ত মানুষের মিছিল চলছে। দ্রব্যমূল্য সাধারণ মানুষের ক্রয়ের নিয়ন্ত্রণে নেই। এখানে সকল আন্দোলন ভালো আলোর মুখ দেখতে পায় না। পুরোপুরি প্রকাশ্যে সব আন্দোলন দানাবাঁধার আগেই থেমে যায়। মানুষ এখন ক্ষুধা নিয়ে এবং পিছনে ঘরে ঘরে রেখে আসা না-খাওয়া বৃদ্ধ বাবা-মা ও অভুক্ত শিশুদের কথা মনে এলে বেশি সময় আন্দোলনের মাঠে টিকতে পারে না। নেতাদের বিলাসবহুল গাড়ি, অফিস ও নেতা ব্যক্তির পুলিশ প্রহরায় হাড্ডিসার দুর্বল মানুষগুলো পুলিশের সামনে দাঁড়িয়ে ভয় পায়। তাদের চোখের সামনে ভেসে ওঠে ঘরে অসহায় মা বাবা ও সন্তানের কথা। তখন সে তার গণতান্ত্রিক অধিকার আদায়ের আন্দোলনে নিজের জীবন হারিয়ে মরার চেয়ে ধনিক শ্রেণির শোষণ যন্ত্র কারখানায় খেটে কিংবা রিকশা, টিলা কাটা, কুলি মজুর হয়ে নিজের শরীরকে গাধার মতো দাসের মতো খাটিয়ে ঘরের মায়ার মানুষের জীবন বাঁচানোর জন্যে অল্প চাল, ডাল, আলু নিয়ে যায়। এ শুধু আমার দেশ নয়, এগুলো হচ্ছে আমাদের মতো পশ্চাৎপদ দেশের মানবাধিকার আদায়ের জন্যে আন্দোলন করার এক বড়ো সমস্যা। 

 

সময়ের সাথে সাথে নানান রকম অবকাঠামো গড়ে উঠলেও গণতন্ত্রের ক্ষেত্রে আমরা বিশ্বের উন্নত দেশের সাথে মিলিয়ে দেখলে সহজেই বুঝতে পারা যায় আমরা পশ্চাৎপদ এক রাজনৈতিক কাঠামোতে হাবুডুবু খাচ্ছি বছরের পর বছর। রাজনৈতিক উন্নয়ন না-হওয়া এক পশ্চাৎপদ দেশের গণতন্ত্র চর্চা এক ধরনের বহুরূপী ফাঁকি। আমাদের একটা ভয়াবহ সমস্যা হচ্ছে, যে দেশের মানুষের ভাষা আন্দোলন, ঊনসত্তরের গণ অভ্যূত্থান, স্বাধীনতা আন্দোলন এবং স্বাধীন বাংলাদেশে দীর্ঘ নয় বছর সামরিক স্বৈরাচারী সরকারের বিরুদ্ধে সংগ্রামের ঐক্যবদ্ধ শক্তি ছিলো আমাদের ছাত্র সমাজ, সেই ছাত্র সমাজ এখন আর কোনো বিষয়ে ঐক্যবদ্ধ হতে পারে না। এখানে পুঁজিবাদের এক খেলা চলে। হ্যাঁ, পুঁজিবাদী রাষ্ট্র ব্যবস্থায় যে কোনো বর্তমান থাকা শাসক গোষ্ঠী ও ক্ষমতা লাভের আকাঙ্খায় অপেক্ষারত ওই এক-ই চরিত্রের গোষ্ঠীর রাজনীতিই হলো বিভেদ জিইয়ে রেখে সংগ্রামী শ্রেণির নৈতিক চরিত্রে ধ্বস নামাতে নানা রকম লোভে ওই শক্তিকে কাছে ভিড়িয়ে রাখা। শাসক গোষ্ঠী কিংবা ব্যাপক অর্থে শোষক গোষ্ঠী সংগ্রামী ছাত্র সমাজ ও সংগ্রামী শ্রমিক শ্রেণিকে ঐক্যবদ্ধ হওয়ার পথে বাধা হয়ে দাঁড়ায় লোভের টোপ ফেলে। আর নৈতিক চরিত্র হারানো ছাত্র সমাজ ও শ্রমিক শ্রেণি শাসক গোষ্ঠী কিংবা শোষক গোষ্ঠী থেকে অল্প সুবিধা পেয়ে শাসক গোষ্ঠী জিন্দাবাদ স্লোগান দিয়ে আন্দোলনের মাঠ দখল করে রাখে। তাদের হাতে লাঠিসোঁটা থাকে এবং তারা পুলিশ প্রহরায় বীরদর্পে রাজপথ দখল করে রাখে। এভাবেই শোষক রাজা তাদের রাজতন্ত্র চালিয়ে যায়। এখানে গণতন্ত্র বারবার মুখ থুবড়ে পড়ে থাকে রাস্তার পাশে ফুটপাতে। ফুটপাতেও গণতন্ত্র নাই। সেখানে ক্ষমতার দাপটে চলে ফুটপাত দখল এবং চাঁদাবাজি। ক্ষমতাসীনরা সব-ই দেখে। এসবই হচ্ছে আমাদের মতো পশ্চাৎপদ দেশের গণতন্ত্র চর্চার নমুনা। 

 

দীর্ঘ লেখা অনেক সময় পাঠকের ধৈর্য্য চ্যুতির কারণ হয়ে উঠে। তাই মূল বিষয়টিতে আলোকপাত করছি। আমাদের সমাজের মানুষরা দীর্ঘ সংগ্রামের পরেও প্রকৃত অর্থে গণতন্ত্র পায়নি। আমাদের সমাজের সাধারণ মানুষের জন্যে এখনও কোনো কোনো সংগঠন গণতান্ত্রিক অধিকার আদায়ের জন্যে, সমাজতান্ত্রিক আন্দোলন করছেন। কিন্তু ; তারা-ও পুঁজিবাদী রাষ্ট্রের শাসকদের দ্বারা প্রভাবিত হয়ে বিভক্ত হয়ে আছেন। এভাবে বিচ্ছিন্ন থাকতে থাকতে একসময় তাদের ঝান্ডাটি তুলে ধরার মতো মানুষ পাওয়া যাবে না। কারণ, গণতন্ত্র ও সমাজতন্ত্রের ঝান্ডাটি উড়াতে শক্তি লাগে। এখন প্রয়োজন হয়েছে ঐক্যবদ্ধ হওয়ার এবং মানুষের জন্যে প্রকৃত গণতান্ত্রিক অধিকার আদায়ের সংগ্রাম করে মানুষকে শোষণ মুক্ত সমাজ উপহার দেয়ার।

 

লেখক : মোহাম্মদ আব্দুল হক, কলামিস্ট ও প্রাবন্ধিক