জ্যাঠী আম্মা বারান্দায় বসে উঠুনে কবুতরগুলোকে খাবার ছিটিয়ে দিচ্ছেন। আর বিড়বিড় করে বলছেন, 'সাবধান হইয়া যাও। ভাই বোন ঠকানো সম্পদে আল্লাহর রহমত থাকে না। সুখ থাকে না।'

জ্যাঠী আম্মা অনেক কষ্ট বুকে জমাটবদ্ধ করে রেখেছেন। জ্যাঠী আম্মা তার শখের কবুতরগুলোর সাথে সকাল বিকাল একা একা কথা বলেন, দুনিয়া জুড়ে মানুষ একে অন্যকে ঠকায়। রক্তের সম্পর্কের মানুষও প্রতারণা করে।


জ্যাঠী আম্মা মাঝে মাঝে চিৎকার করে বলেন, 'সাবধান হইয়া যাও। ভাই বোন ঠকানো সম্পদে আল্লাহর রহমত থাকে না। সুখ থাকে না।' 

তাদের বাড়ি একটি জেলা শহরের সন্নিকটে সবধরনের যোগাযোগে উন্নত এক গ্রামে। তাই গ্রামের বাড়িতে থেকেই শহরের সাথে সবধরনের যোগাযোগ রক্ষা করতে তাদের অসুবিধা হয় না। এক বাড়িতে ওরা তিন ভাই ও দুই বোন। ওরা নিজাম শেখের সন্তান। নিজাম শেখের পাঁচ সন্তানের প্রকাশিত নাম হলো, বড়ো ছেলে আতিক শেখ, মেজো ছেলে জাকির শেখ এবং ছোটো ছেলেটির নাম মানিক শেখ। তাদের দুই বোন রহিমা শেখ এবং সুহানা শেখ। রহিমা শেখ ও সুহানা শেখ তাদের ভাই মানিক শেখের বড়ো এবং আতিক শেখ ও জাকির শেখের ছোটো। তাদের বাবা নিজাম শেখ এবং জ্যাঠা নিয়ামত শেখ এক-ই বাড়িতে থাকেন। তাদের এক-ই বাড়িতে থাকা হলেও এবং এক-ই পুকুরে সাঁতার কাটা আর সামনের এক-ই উঠুনে খেলাধূলা ও কাপড়চোপড় রোদে শোকানো চললেও তাদের সংসার রান্না ও জায়গা জমি সবকিছুই আলাদা।

জ্যাঠা নিয়ামত শেখ ও তার স্ত্রীর কোনো সন্তান নাই। নিজেদের কোনো সন্তান না-থাকার কারণে তারা নিজাম শেখের ছোটো মেয়েকে নিজেদের কাছে নিয়ে আসেন। সেই থেকে নিজাম শেখের ছোটো মেয়ে সুহানা শেখ ছোটো বেলা থেকে তার জ্যাঠা ও জ্যাঠী আম্মার ঘরে নিজের সন্তানের মতো লালিত পালিত হয়েছে। সেই থেকেই সুহানা শেখ জ্যাঠাকে আব্বা আর জ্যাঠী আম্মাকে আম্মা ডাকায় অভ্যস্ত হয়ে উঠে। কিন্তু ; বাড়ির আর সকলে নিয়ামত শেখকে জ্যাঠা ও উনার স্ত্রীকে জ্যাঠী আম্মা বা মাঝে মাঝে সংক্ষিপ্ত শব্দ উচ্চারণে জ্যাম্মা বলে ডাকে। এখানে পিতার বড়ো ভাইকে চাচা না-বলে জ্যাঠা বলে এবং চাচীকে জ্যাঠী আম্মা বলে ডাকা হয়।

দিনে দিনে নিজাম শেখের ছেলেরা লেখাপড়া শিখে বড়ো হয়ে একেকজন আলাদা আলাদা চাকরি করে এবং বিয়েও করে। 

নিজাম শেখ মারা গেছেন অনেক বছর আগে এবং নিজাম শেখের স্ত্রীও আর বেঁচে নেই। তারা বেঁচে থাকতেই তাদের বড়ো মেয়ে রহিমা শেখের বিয়ে দিয়ে তাকে শ্বশুর বাড়ি পাঠিয়ে দিয়েছেন। সে শ্বশুর বাড়িতে থাকে। মা-বাবা যতোদিন বেঁচে ছিলেন ততোদিন বিয়ের পরেও রহিমা শেখ বাবার বাড়িতে প্রতি বছর দুইবার আসা যাওয়া করেছেন। এরপর বড়ো ভাইয়ের অনাগ্রহ বুঝতে পেরে তিনি আর বাবার বাড়িতে আসেন না।

নিয়ামত শেখ সুহানা শেখকে নিজের মেয়ের মতো বড়ো করেছেন আগলে রেখেছেন এবং বিয়েও দিয়েছেন। এরপর তিনিও মারা গেছেন অনেক বছর হয়। এখন বাড়িতে জ্যাঠী আম্মা থাকেন সুহানা শেখকে নিয়ে। সুহানা শেখের বিয়ে হয়েছে পাশের গ্রামে। কিন্তু ; জ্যাঠী আম্মা একা তাই তাকে তার কাছে এখানেই নাতি নাতনি সহ রেখে দিয়েছেন। সুহানা শেখের স্বামী আলকাছ ভূঁইয়া একজন ব্যবসায়ী। যেহেতু স্ত্রী ও সন্তান জ্যাঠী আম্মার মায়ার টান ছাড়তে পারে না, তাই তিনিও শ্বশুর বাড়িতে স্ত্রী সন্তান নিয়ে শাশুড়ির কাছে এখানেই থেকে যান।

আতিক শেখ চাকরি পেয়ে যায় বাড়ির কাছেই একটি সরকারি অফিসে। তৃতীয় শ্রেণির মর্যাদার হিসাব নিকাশের কাজ এবং বাড়ির কাছের অফিস হওয়ার সুবাদে সে সহজেই বাড়ি থেকে অফিসে যাওয়া আসা করে। যেহেতু হিসাব নিকাশ মিলানো তার কাজ, তাই সে অফিসের হিসাবের কাজে গরমিল দেখিয়ে এবং তার টেবিলে আসা অন্য অনেকের হিসাবের ফাইল নানান ফন্দি করে কিছুদিন আটকে রেখে টাকা আদায় করতে সে ছাড়ে না। এমন দুর্নাম তার আছে। সেজন্যে কয়েকবার তাকে শাস্তি হিসেবে অন্যত্র বদলি করা হয়েছে। কিন্তু ; সে প্রতিবারেই তার বাড়ি দেখাশোনা করার কেউ নেই ইত্যাদি কথা বলে তার বড়ো বসকে ইমোশনাল ব্ল্যাকমেইল করে বড়ো অংকের টাকা ঘুষ দিয়ে আবার তার পুরনো অফিসে চলে আসে। সে খুব-ই ধুরন্ধর প্রকৃতির। আসলে আতিক শেখ তার বাবার বাড়ির সম্পদ একা ভোগ করার জন্যেই বাড়িতে থেকে যাওয়ার লোভ সামলাতে পারে না। 

জাকির শেখ চাকরি পায় বাড়ি থেকে প্রায় দুইশো কিলোমিটার দূরের এক বড়ো বানিজ্যিক শহরে। সেখানেই সে স্ত্রী সন্তান নিয়ে তার সংসার সাজিয়েছে। তার সরকারি চাকরির বেতন যেমন-ই হোক, এর বাহিরে-ও সে এটা-সেটা করে ঘুষ বানিজ্যের মাধ্যমে অল্প কয়েক বছরে প্রচুর টাকা করে ফেলেছে। জাকির শেখ মানসিকতার দিকে ভালো হলেও অফিসিয়াল সিস্টেম লসের কারণে শতোভাগ সততার সাথে জীবন নির্বাহ করতে পারে না। সে ওই শহরে একটা বাসাও কিনেছে। সে খুব একটা বাড়িতে আসতে পারে না। ঈদে কিংবা গ্রামের কারোর বিশেষ কোনো উৎসবে দাওয়াত পেলে বাড়িতে আসে। তবে সে পরিবারের কারো অসুবিধার কথা শুনলে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেয়।

আতিক শেখ এবং জাকির শেখ সরকারি চাকরিতে ঢুকে অল্প দিনের মধ্যে খুব বেশি টাকা পয়সা করে ফেলেছে। এ নিয়ে গ্রামের মানুষের মাঝে কথা হয়। মসজিদের সামনের রাস্তায় উত্তর দিকের মোড়ের ছোট্ট এক দোকানের বারান্দায় বসে মাঝে মাঝে বিকেলে লোকজন এ নিয়ে কথা বলাবলি করে। মানুষ বলে, নিয়ামত শেখ ও নিজাম শেখ উনারা খুব ভালো মানুষ ছিলেন। কিন্তু ; তাদের বড়ো দুই ছেলের যেন-তেন উপায়ে টাকা কামাই করার মারাত্মক নেশায় আসক্তি।

এদিকে মানিক শেখ বাড়ি থেকে একটু দূরে পঞ্চাশ কিলোমিটার দূরের আরেক ছোটো জেলা শহরে একটা বিদেশি এক্সপোর্ট-ইম্পোর্ট কোম্পানিতে চাকরি করে। তার বেতন ভালো। যা বেতন পায় স্বচ্ছতায় জীবন কাটায়। সে ওই ছোটো শহরে থাকলেও কাছাকাছি দূরত্বের কারণে প্রতি মাসে একবার বাড়িতে আসে এবং তখন বাড়ির আশেপাশে কি কি গাছ আছে, মা-বাবার রেখে যাওয়া কয়টা গরু আছে, পুকুরের মাছ, ক্ষেতের ধান এসবের খোঁজ খবর নিতে চেষ্টা করে। মানিক শেখের এসব খোঁজ খবর নেয়া আতিক শেখ ও তার বউয়ের পছন্দ হয় না। তাই দিনে দিনে মানিক শেখের সাথে আতিক শেখের সম্পর্কের অবনতি ঘটে। এমনকি আতিক শেখের ছেলেও চাচা হিসেবে মানিক শেখকে সামান্য সম্মানটুকুও করে না। বাড়িতে আসলে সুযোগ পেলেই চাচার সাথে বেয়াদবি করে। শুধু তা-ই নয়। আতিক শেখের ছেলে ফুপুদের সাথেও অশ্রদ্ধা দেখায়। এসবই হচ্ছে আতিক শেখ ও তার বউয়ের সাজানো ষড়যন্ত্র। যাতে করে ভাতিজার বেয়াদবি সয়ে মানিক শেখ ও ফুপুরা আস্তে আস্তে বাড়িতে আসা বাদ দিয়ে দেয়।

জ্যাঠী আম্মা সুহানা ও নাতি নাতনি নিয়ে ভালো-ই চলছিলেন। এখানে জ্যাঠী আম্মা নাতি ও নাতনিকে স্কুলে ভর্তি করিয়েছেন। কিন্তু ; হঠাৎ সুহানা শেখের শাশুড়ি অর্থাৎ আলকাছ ভূঁইয়ার মা মারা গেছেন। তাই এখন শ্বশুরের দেখাশোনা করার জন্যে শ্বশুর বাড়িতে সুহানাকে চলে যেতে হয়েছে। সেজন্যে জ্যাঠী আম্মা একা হয়ে গেছেন। একদিকে জ্যাঠী আম্মার বয়স হয়েছে এবং এসময়ে একা বাড়িতে তার ভালো লাগে না। তাই দিনে দিনে তিনি আরও অসুস্থ হয়ে পড়েন। পাশের ঘরে আতিক শেখ ও তার বউ থাকলেও তারা জ্যাঠী আম্মার প্রতি ততোটা মনোযোগ কোনো সময়-ই দেয় না। 

মাঝে মাঝে জ্যাঠী আম্মার এক ভাতিজা আসে।একদিন থেকে যায়। কিন্তু ; জ্যাঠী আম্মা তাকে খুব একটা ভালো ভাবে দেখেন না। কারণ, ওর বাবা আর সে মিলে জ্যাঠী আম্মাকে তার বাবার বাড়ির প্রাপ্য অধিকার থেকে বঞ্চিত করেছে। কিন্তু ; ওই ঠকানো সম্পদও ওরা বেশি দিন ধরে রাখতে পারেনি। পঞ্চাশ বছরেই তাদের সব শেষ। 

জ্যাঠী আম্মা মাঝে মাঝে একা একা বিড়বিড় করে বলেন, সাবধান হইয়া যাও। ভাই বোন ঠকানো সম্পদে আল্লাহর রহমত থাকে না। সুখ থাকে না।

এদিকে জ্যাঠী আম্মার ভাতিজা এখানে আসা যাওয়া করে দেখে আতিক শেখের মনে সন্দেহ হয়। তাই আতিক শেখ ফোন করে জাকির শেখকে বাড়িতে আসতে বলে। 

জ্যাঠী আম্মাকে নিয়ে আতিক শেখ ও জাকির শেখ বসে। তারা জ্যাঠী আম্মাকে বুঝায়, আপনি একা থাকেন। এখন আর আলাদা রান্না করে খাওয়ার দরকার নাই। আমাদের কাছেই থাকবেন এবং খাবেন। আর একটা কথা বলি, আপনার অবর্তমানে আইন গত ভাবে আপনার বাড়িতে আপনার ভাতিজার অধিকার হয়ে যাবে। এখন আপনি বলেন, আমাদের বাপদাদার এই ভিটায় যদি অন্য গ্রামের মানুষ এসে দখল নেয়, তাহলে সেটা কি খুব ভালো দেখাবে? 

জ্যাঠী আম্মা বলেন, তোমরা কি চাও? 

আতিক শেখ : আমরা চাই, আমাদের বাড়িতে আমাদের ভাই বোন ছাড়া আর কেউ যেনো এসে ঝামেলা না-করে। 

জ্যাঠী আম্মা বলেন, আমার ভাই-তো আমাকে আমার বাপের বাড়ির ভিটা থেকে বঞ্চিত করেছিলো। তোমরা তোমাদের বোনদেরকে বাড়ির ভিটা থেকে বঞ্চিত করবে না-তো, কথা দাও।

জাকির শেখ বলে, জ্যাঠী আম্মা, আপনি কোনো চিন্তা করবেন না। এই ভিটায় আমরা ভাই বোনেরা হেসে খেলে বড়ো হইছি। এখানে বোনদের আইনগত অধিকার আছে। আমরা তাদেরকে ঠকাবো না। দরকার হলে, আমরা বোনদেরকে আরো বেশি দিবো।

জ্যাঠী আম্মা বলেন, আমি-তো সুহানাকে-ই আমার মেয়ে মনে করে লালন পালন করেছি। আমি-তো মনে করি আমার বাড়ি ও সম্পত্তির মালিক আমার মেয়ে ও নাতি নাতনি হবে। মানিক শেখও আমাকে মাঝে মাঝে আম্মা বলে। তাই ভাবছিলাম, আমার সম্পত্তির একটা অংশ তাকে দিয়ে যাবো। 

জাকির শেখ : জ্যাঠী আম্মা সুহানা-তো আমাদেরই বোন। এখন আপনি সুহানাকে একা সব দিয়ে দিবেন। এটা কি ঠিক হবে? 

জ্যাঠী আম্মা : আচ্ছা বাবা তোমরা বলো, কোনটা করলে ভালো হবে? 

আতিক শেখ : আমি বলি কি, বোনেরা-তো আর এখানে আসবে না। তাই আপনার সম্পত্তি আমরা তিন ভাইকে দিয়ে দেন।

জ্যাঠী আম্মা : শোনো বাবারা। আমি বুঝতে পারছি। তোমরা এই বাড়িতে বোনদেরকে জায়গা দিতে চাও না। আমার ভাই-ভাতিজাও আমাকে বাড়িতে জায়গা দেয়নি। তোমরা যেহেতু মনে মনে এই বাড়ি তোমাদের একার হবে চিন্তা করে ফেলেছো, তাহলে আমার মেয়ে ও নাতি নাতনি এখানে তোমাদের পাশে থেকে সুখ পাবে না। 

তোমরা এক কাজ করো। আমার এই বাড়ি তোমরা তিন ভাইয়ের নামে নিয়ো। আর আমার ফসলের জমি অর্ধেক আমার মেয়ে সুহানাকে দিয়ো। আর অর্ধেক রহিমাকে দিয়ে দিয়ো।

আরেকটা কথা বলি, তোমরা যেহেতু আমার ভিটা পুরোটাই পেয়ে যাবে, তাহলে তোমাদের বাবার নামের ভিটায় তোমরা বোনদেরকে ঠকিয়ো না। তারা এখানে এসে ঘর না-করলেও বাড়ির ভিটায় তাদের দখল বুঝিয়ে দেয়া তোমাদের দায়িত্ব। তা-না-হলে তোমাদের সম্পদ হলেও, তাদের অভিশাপে তোমাদের পরিবারের সুখ হবে না। 

জাকির শেখ : জ্যাঠী আম্মা, আমি বলছিলাম, এখন-তো আর আপনার সম্পত্তি দেখাশোনার চিন্তা নাই। আপনি আমার সাথে শহরে চলেন। সেখানে আমার সাথে মায়ের মতো থাকতে পারবেন। খাওয়া ও চিকিৎসা সবই আমি ব্যবস্থা করবো।

জ্যাঠী আম্মা : আমি জানি বাবা, তোমার মনটা নরম আছে। কিন্তু ; জীবনের শেষ কয়টা দিন এই গ্রামের এই ভিটাতেই থাকতে চাই।

এরপর জ্যাঠী আম্মা বলেন, আর কোনো কথা বলার দরকার নাই। জাকির-তো শহরে চলে যাবে। আতিক তুমি ওইভাবেই দলিল লিখে আমার দস্তখত নিয়ে নিয়ো। আমি লেখাপড়া জানি না। তুমি আমার সাথে প্রতারণা করিও না।

আতিক শেখ : কি বলেন জ্যাঠী আম্মা। আপনি-তো আমাদের মায়ের মতোই। 

জ্যাঠী আম্মা : আতিক, আরেকটা কথা। আমার অসুখ বিসুখ হলে শহরে নিয়ে বড়ো ডাক্তার দেখাবে। আর যেহেতু তুমি সবসময়ই গ্রামের বাড়িতে থাকবে, সবকিছুর সুবিধা ভোগ করবে, তাই, আমার সুহানা আর নাতি নাতনিদেরকেও তুমি সবসময় বাড়িতে দাওয়াত দিয়ে আনবে। ঠিক আছে? 

আতিক শেখ : এসব আপনাকে ভাবতে হবে না। 

জ্যাঠী আম্মা : মানিক এখানে থাকলে ভালো হতো। সে তোমাদের ছোটো ভাই হলেও, তার বিবেক বিবেচনা ছোটোবেলা থেকেই ভালো। তোমরা মানিককে আনোনি কেন?

আতিক শেখ : মানিক এখন খুব ব্যস্ত। আপনি চিন্তা করবেন না। মানিক শেখ আমাদের আপন ছোটো ভাই। আর রহিমা শেখ ও সুহানা শেখ আমাদের আদরের দুই বোন। আমরা এই ভিটাতেই একসাথে থাকবো।

জ্যাঠী আম্মার কাছ থেকে জ্যাঠী আম্মার ভিটা ও ফসলের জমি তিন ভাইয়ের নামে লিখে নেয়ার ব্যবস্থা করে আতিক শেখ। জাকির শেখ কিছু জানলেও মানিক শেখ ওইসব বিষয়ে তখনও তেমন কিছু বুঝে না। জাকির শেখ ও মানিক শেখ থাকে শহরের বাসায়। 

এরপর আতিক শেখ জ্যাঠী আম্মার থেকে পাওয়া সব জমি একে একে বিক্রি করে দেয়। জ্যাঠী আম্মার দেয়া ভিটায় পাকা দালান ঘর তোলার কাজ শুরু করে। শুধু তাই নয়, জাকির শেখ ও মানিক শেখের নিকট থেকেও টাকা এনে পাকা বাড়ির কাজ চালায়।

সুহানা শেখ জ্যাঠী আম্মাকে দেখতে আসলে আতিক শেখ ও তার বউ এটা সেটা বুঝিয়ে বিদায় করে দেয়।

জ্যাঠী আম্মার শরীর বয়সে ও অসুখে আর ভালো খাবার ও সঠিক চিকিৎসার অভাবে একেবারে চলে না। বিছানায় শুয়ে থাকেন।

জ্যাঠী আম্মা বলেন, আতিক আমার শরীর খুব খারাপ। আমাকে শহরে নিয়ে বড়ো ডাক্তার দেখাও।

আতিক তখন পাশের বাজারে গিয়ে ওষুধের দোকান থেকে ওষুধ এনে খাওয়ায়। শহরে বড়ো ডাক্তারের কাছে নিয়ে যায় না।

জ্যাঠী আম্মা বিছানায় শুয়ে শুয়ে চোখের জল ফেলতে ফেলতে বিলাপ করে বলেন, ওরে আতিক, তুমি আমারে কথা দিছিলে আমার অসুখ হলে শহরে নিয়ে ভালো ডাক্তার দেখাবে। আমার সুহানাকে ঠকাবে না। আমি বিশ্বাস করেছিলাম। এখন আমার লক্ষ লক্ষ টাকার সম্পত্তি পেয়ে তোমরা আমার সাথে বেইমানি করেছো। আল্লাহ এর বিচার করবেন।

জ্যাঠী আম্মা মরার আগে জ্যাঠী আম্মাকে দেখতে এসেছিলেন রহিমা শেখ ও সুহানা শেখ। তাদেরকে জ্যাঠী আম্মা বলেন, আমাকে আতিক ডাক্তারের কাছে নিয়ে যায় না। তার বউটাও ভালো মুখে কথা বলে না। আমি আশা করেছিলাম, মরার আগে পাকা বাড়িতে একদিন শুয়ে যাবো। কিন্তু ; ঘরের কাজ শেষ না-করে আমাকে এই মাটিতে ছাঁটিতে শুইয়ে রাখছে।

জ্যাঠী আম্মা বলেন, সাবধান হইয়া যাও। ভাই বোন ঠকানো সম্পদে আল্লাহর রহমত থাকে না। সুখ থাকে না।

চোখ ঘুড়িয়ে আবার বলেন, সাবধান হইয়া যাও। ভাই বোন ঠকানো সম্পদে আল্লাহর রহমত থাকে না। সুখ থাকে না।

এই কথা বলতে বলতে জ্যাঠী আম্মা মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েন।

মৃত্যুর পরে বাড়িতে মেজবান খাওয়ানোর জন্য আয়োজন করা হয়। আশপাশের মানুষ দাওয়াত খেতে আসে। জ্যাঠী আম্মার ভাতিজা-ও আসে। এলাকার চেয়ারম্যান, মেম্বার আসেন। 

বাড়ির উঠুনে খাওয়ানোর ব্যবস্থা করা হয়েছে। ঠিক খাওয়া শুরু করার আগে জ্যাঠী আম্মার ভাতিজা নূর উদ্দিন উপস্থিত সকলের উদ্দেশ্যে বলে, উপস্থিত সমাজের সম্মানিত মানুষজন। আমার ফুপুআম্মা নিঃসন্তান ছিলেন। তিনি তার সমস্ত সম্পত্তি আতিক শেখ, জাকির শেখ ও মানিক শেখকে লিখে দিয়ে ছিলেন। লক্ষ লক্ষ টাকার সম্পদ হবে। আমার ফুপুআম্মা বছরের পর বছর রোগে ভোগেছেন। আতিক শেখ সবসময় বাড়িতে থাকতেন। কিন্তু ; কোনোদিন আমার ফুপুআম্মাকে কাছেই শহরের ডাক্তারের কাছে নিয়ে যাননি। আপনারা বলেন, আপনারা কি কোনো দিন দেখেছেন এই বাড়ি থেকে এম্বুলেন্সে করে তাদের জ্যাঠী আম্মাকে নিয়ে চট্টগ্রাম বা ঢাকার কোনো হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়েছে? তাদের জ্যাঠী আম্মা তাদেরকে যতো সম্পদ দিয়ে গেছেন তাতে উনাকে চট্টগ্রাম বা ঢাকার বড়ো হাসপাতালে বড়ো ডাক্তার দেখিয়ে সেবা করলেও ওই সম্পদের শতকরা দশভাগও খরচ হতো না। কিন্তু ; আমার ফুপুআম্মা ওদের জ্যাঠী আম্মা মৃত্যুর আগে শান্তিতে চিকিৎসা সুবিধাও ভোগ করে যেতে পারেননি।

নূর উদ্দিনের বক্তব্য শেষ হলে উপস্থিত সমাজের নিমন্ত্রিত অতিথিরা আর মেজবান খাওয়ার জন্যে বসে থাকেননি। সকলেই ছি: ছি: বলতে বলতে চলে যান। 
নূর উদ্দিনও চলে যায়। 

মেজবান উপলক্ষে জাকির শেখ ও মানিক শেখ বাড়িতে এসেছিলো। তারা দূরে থাকার কারণে এতোসব জানতো না। তারা আতিক শেখ ও তার বউয়ের এমন জঘন্য কাজের জন্যে তাদেরকে ধিক্কার দেয়।

এরপর জাকির শেখ ও মানিক শেখ মিলে আতিক শেখকে বলে যায়, যা আকাম করার করেছো। পরিবারের মান-মর্যাদা একেবারে নষ্ট করেছো। এখন শোনো, আমাদের মা-বাবার সম্পত্তি যেহেতু সব-ই তোমার কাছে আছে। তুমি দুই মাসের মধ্যে উকিলের সাথে কথা বলে ওইসব সম্পত্তির আইন অনুযায়ী শৃঙ্খলা করে দলিল তৈরি করো। ভিটা-বাড়িতে ও জমিতে সবখানেই বোনদের ন্যায্য অধিকার বুঝিয়ে দেয়া হবে।

এরপর তারা-ও বিকেলের গাড়িতে চড়ে লজ্জাবনত হয়ে গ্রাম ছাড়ে।

মাস যায়, বছর যায়। আতিক শেখ এখনও সম্পত্তির সুষ্ঠু বন্টন ব্যবস্থা করার উদ্যোগ নেয় না। সে পাকা ঘরে লোহার গেইট লাগিয়ে তার বউ ছেলে নিয়ে থাকে আর পুকুরের মাছ, নারিকেল, আম, জাম, পেয়ারা, সবজি এবং ধানক্ষেতের ধান খায় আর বিক্রি করে ব্যাংকে টাকা জমায়।

জাকির শেখ ও মানিক শেখ সেই যে সমাজের মানুষের সামনে তাদের বড়ো ভাইয়ের অপকর্মের ঘটনায় লজ্জিত হয়ে বাড়ি ছেড়েছে, এরপর গত তিন বছরে আর আসেনি। একদিকে আতিক শেখের উদ্দেশ্য সফল হয়েছে। সে-তো এমনটি-ই চেয়েছিলো। ওরা বাড়িতে না-এলে সে ধীরে ধীরে সবকিছু তার করে নিয়ে দখল করে একা খাবে।

বাড়িতে প্রচুর খেজুরের গাছ আছে। পুকুর পাড়ে ও বাড়ির চারপাশে সবমিলিয়ে প্রায় চল্লিশটি গাছ থেকে প্রতি শীত কালে হাঁড়ি হাঁড়ি খেজুরের রস হয়। আতিক শেখ ও তার বউ ওই রসের পিঠা নিজে খায় এবং আতিক শেখ তার শ্বশুর বাড়িতে শালা ও শালার বউকে পাঠিয়ে দেয়। কিন্তু ; কোনো দিনও কাছাকাছি থাকা তার দুই বোন রহিমা শেখ ও সুহানা শেখকে দেয় না। এবছর শীতের মাঝামাঝি সময়ে রহিমা শেখ ও সুহানা শেখ তাদের স্বামী ও সন্তান নিয়ে বাড়িতে এসেছিলো। কিন্তু ; ওদেরকে দেখতে পেয়েও আতিক শেখ, তার বউ এবং তার ছেলে গেইট খুলে দেয়নি। রহিমা শেখ ও সুহানা শেখ অনেক ডাকাডাকি করেছে। তবুও তারা গেইট খুলে দেয়নি। 

রহিমা শেখ ও সুহানা শেখ ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কেঁদে কেঁদে চোখের জলে বাবার বাড়ির ভিটা ভিজিয়েছে।এই ঘটনার সাক্ষী হয়ে রইলো প্রতিবেশী আরও পাঁচটি পরিবারের সকলে। 

প্রতিবেশীদের উদ্দেশ্য করে শুনিয়ে শুনিয়ে রহিমা শেখের স্বামী আবু তোরাব ও সুহানা শেখের স্বামী আলকাছ ভূঁইয়া বলে গেছে, আর না। অনেক সয্য করেছি। আমরা আজকেই থানায় গিয়ে পুলিশের খাতায় একটি সাধারণ ডায়েরি করবো এবং এক-ই সাথে উকিলের সাথে গিয়ে এ বিষয়ে পরামর্শ করে মামলা করবো।

তিনদিন পরে থানা থেকে পুলিশ আসে আতিক শেখের বাড়িতে। 

আতিক শেখ ধুরন্ধর লোক। সে পুলিশকে এটা সেটা বুঝিয়ে, আপ্যায়ন করিয়ে, খুশি করে বিদায় করে দিয়েছে।

সে গ্রামের মসজিদের সামনের রাস্তা পাকা করণের জন্য বড়ো অংকের চাঁদা দেয়। গ্রামের যুবকদের একটি ক্লাব আছে। সেখানে টাকা দিয়ে যুবকদেরকে তার পক্ষে রাখতে চেষ্টা করে। মা-বাবার সম্পত্তির উপর তার ভাই ও বোনেরা এসে দাবি করলে যাতে গ্রামের মানুষ তার পক্ষে থাকে, সেজন্যে আতিক শেখের নানান রকম ছলচাতুরী চলতেই থাকে।

আবু তোরাব ও আলকাছ ভূঁইয়া লোক লাগিয়ে জানতে পেরেছে, আতিক শেখ গ্রামে থাকলেও শহরে সে একটা ফ্ল্যাট কিনেছে এবং সেটি ভাড়া দিয়েছে। সে আরেকটা কাজ করেছে, এই বাড়িতে প্রবেশের যে পুরনো পথটি ছিলো তাদের দাদার নামে, সেটি সে দেয়াল দিয়ে বন্ধ করে দিয়েছে। নতুন একটা পথ তৈরি করেছে তার বউয়ের নামে কেনা জায়গা দিয়ে। তার উদ্দেশ্য হলো, ভবিষ্যতে এই বাড়িতে ভাই ও বোনদেরকে-তো ঢুকতে দিবে-ই না, এমনকি পরবর্তীতে জাকির শেখ ও মানিক শেখের ছেলেমেয়েরাও এই বাড়িতে প্রবেশের পথ খুঁজে পাবে না। 

এসব বিষয়ে বিস্তারিত তথ্য সংগ্রহ করে তারা দুই বোন ও ভগ্নীপতি জাকির শেখ ও মানিক শেখের সাথে দেখা করে এবং সবকিছু খোলে বলে। আতিক শেখ যে এমন হীন ষড়যন্ত্রের নক্সা এঁকেছে তা বুঝতে পেরে জাকির শেখ ও মানিক শেখ তাদের ভগ্নীপতিদেরকে বলে, যেভাবে মামলা করা যায় সেভাবে যেনো তারা মামলা করেন। 

এরপর রহিমা ও আবু তোরাব আর সুহানা ও আলকাছ ভূঁইয়া আইনের পথে হাঁটে। যথাসময়ে আদালত থেকে আতিক শেখের বাড়িতে তার বিরুদ্ধে মা-বাবার সম্পত্তি জবরদখল করে রাখা সংক্রান্ত মামলার নোটিশ আসে। এক-ই সাথে দুর্নীতি দমন কমিশন থেকেও আতিক শেখ ও তার স্ত্রীর নামে শহরের ফ্ল্যাট ও সমস্ত সম্পত্তির ও চারটি ব্যাংকে রাখা টাকার উৎস কি তার হিসাব চাওয়া হয়েছে। 

এখন-তো আতিক শেখের মাথায় হাত। সে তার বউকে নিয়ে রহিমা শেখ ও সুহানা শেখের বাড়িতে গেলে তারা জানিয়ে দিয়েছে, অনেক সুযোগ দেয়া হয়েছে, আর না, এখন সবকিছু রাষ্ট্রের আইন অনুযায়ী হবে।

এদিকে জ্যাঠী আম্মার ভিটায় বানানো পাকা বাড়িতে শুয়ে আতিক শেখের আর ঘুম আসে না। বিছানায় ছটফট করে। আতিক শেখের বউয়ের অবস্থাও এক-ই রকম। এপাশ ওপাশ করে, ঘুম আসে না। গভীর রাতে জ্যাঠী আম্মার গলার আওয়াজ শুনতে পায় তারা , সাবধান হইয়া যাও। ভাই বোন ঠকানো সম্পদে আল্লাহর রহমত থাকে না। সুখ থাকে না।

আতিক শেখ ও তার বউ ভয় পায়। বিছানায় উঠে বসে। ভয়ে গলা শুকিয়ে যায়। অন্ধকারে দুইজনে বিছানা থেকে একটু দূরে টেবিলের উপর রাখা পানির গ্লাস ধরতে হাত বাড়ায়।

টেবিলের উপর একটা মূর্তি মতো সাদা ধোঁয়া লকলকে জিভ বের করে বলে, 'সাবধান হইয়া যাও। ভাই বোন ঠকানো সম্পদে আল্লাহর রহমত থাকে না। সুখ থাকে না।'

আতিক শেখ ও তার বউ বেহুঁশ হয়ে যায়।।

গল্পকার : মোহাম্মদ আব্দুল হক