বাংলাদেশের ব্যাপক মানুষের শারীরিক কর্ম ব্যস্ততা নাই। শরীরের উপযোগী কাজের অভাব রয়েছে বলে অনেকে কর্মহীন। তবে তাদের মস্তিষ্ক নানান নিরর্থক কাজে ব্যস্ত থাকতে দেখা গেছে গ্রামের চৌরাস্তার কোনো কোণে দোকানের বেঞ্চে বসে বিড়ি ফুকে ফুকে আর মার্কস দুধের বানানো চা গিলতে থাকা মানুষের মাঝে। শহরের গলির মোড়ে কিংবা ফুটপাত দখল করে চা এর টং ঘর ঘিরেও এক শ্রেণির মানুষ মহা ব্যস্ত দেশের রাজনীতি এবং আমেরিকা, ইসরাইল ও ফিলিস্তিন নিয়ে। তবে এদেশে সবচেয়ে বেশি দেখা যায়, মানুষ আছে একপক্ষ সরকার সমর্থক এবং আরেক পক্ষ সরকারের বিরোধী দলের আঠালো সমর্থক। 

এ উভয়পক্ষ খুবই ভয়ংকর সমর্থক। এরা নিজেরা কিছু বুঝতে চায় না। এই উভয়পক্ষের সমর্থকরা কান পেতে থাকে তাদের নেতারা কখন কি নির্দেশ দেন সেদিকে এবং কোনো মতবিনিময় ছাড়াই এরা নিজ নিজ দলের সমর্থক হিসেবে নেতার নির্দেশ পালনে ঝাঁপিয়ে পড়ে। এমন সমর্থককে যদি নেতৃত্ব সঠিক নির্দেশনা দিতে পারেন, তাহলে নিশ্চিত বিজয় ও উন্নতি হবে। যেমন আমরা ১৯৭১ খ্রীষ্টিয় সালে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নির্দেশনা পেয়ে সংগ্রাম করে বিজয় পেয়েছি। এর বাহিরে আমি বিভিন্ন ভাবে পর্যবেক্ষণ করে দেখেছি বাংলাদেশের জনগণের আরেক চেহারা। এখানে সরকারি দল ও বিরোধী দলের সমর্থক ছাড়াও আরও দুটি সমর্থক রয়েছে — এক. উন্নয়ন কার্যক্রম এর সমর্থক এবং দুই. ধ্বংসাত্মক কাজের সমর্থক। ধ্বংসাত্মক কাজের সমর্থকরা মারমুখী। এরা নেতিবাচক চিন্তায় প্রভাবিত। 


এরা যেকোনো ভাবে যে-কারো উন্নয়ন কাজ বা ভালো উদ্যোগের বিরোধিতা করে এবং তাদের বিরোধিতার পক্ষে তাদের মতো একটা যুক্তিও দাঁড় করায়। সবচেয়ে বিস্ময়কর ব্যাপার হলো, এদের পক্ষ নিয়ে সঙ্গে সঙ্গে ওদের সমর্থকরাও উচ্চ স্বরে এমন ভাবে সমর্থন জানায়, তখন যদি কেউ তাদের যুক্তি খন্ডন করে কিছু বলতে যায়, তাহলে প্রায় নিশ্চিত অপদস্ত হয়ে আসতে হবে। উন্নয়ন কার্যক্রম এর সমর্থকরা সবখানে কথা বলে না। এরা মারমুখী না, তাদের কথা ও শারীরিক উপস্থাপনায় ভদ্রতা, সতর্কতা ও সচেতনতা লক্ষ করা যায়। এরা লেখাপড়া করে এবং অলস মস্তিষ্ক নয়, বরং মস্তিষ্কের সচেতন ধ্যানী কর্মী। এরা যুক্তি খোঁজে। আমি যৌক্তিক কারণে মাঝে মাঝে সরকারি দলের সমর্থক আবার কখনও কখনও বিরোধী দলের সমর্থক। 

আমি ধ্বংসাত্মক শক্তির প্রসংশা করি না। এড়িয়ে চলতে চেষ্টা করি। দেখেছি উন্নয়ন কার্যক্রম সম্পর্কিত সমর্থকরা মস্তিষ্কের কাজকে খুব বেশি গুরুত্ব দিয়ে থাকেন। এরা কোনো একক নেতার নেতৃত্ব বা কোনো দলের যেকোনো নির্দেশকে বিনা বিবেচনায় শিরোধার্য করে নেয় না। ধ্বংসাত্মক শক্তির মন্দ কাজকে আড়ালে রেখে এখানে উন্নয়ন কাজ নিয়ে কিছু কথা বলি। আমি এখানে দেখতে পাই, একবিংশ শতাব্দীর ত্রিশ এর দশক পর্যন্ত বাংলাদেশের উন্নয়ন কাজ চলছে এক-ই সাথে ভূমিতে, জলে, আকাশে ও পাতালে। জানা হয়ে গেছে, কোনো দেশের উন্নয়নের জন্যে শিক্ষা ও চিকিৎসার পাশাপাশি যোগাযোগ ব্যবস্থা অগ্রাধিকার পায়। বলা যায় শিক্ষা, চিকিৎসা ও বানিজ্যিক সুবিধা সারা দেশে দ্রুত পৌঁছে দিতে হলে দেশের যোগাযোগ ক্ষেত্রে উন্নয়ন ঘটাতে হয়। বাংলাদেশের স্বাধীনতা অর্জনের পরে ১৯৭২ খ্রীষ্টিয় সাল থেকে ধীরে ধীরে বহুমুখী উন্নয়ন কার্যক্রম শুরু হয়ে যায় এবং তখন থেকেই স্বাধীন বাংলাদেশের রাজনীতির চরিত্রও বদলে যেতে যেতে একেক সময় একেক চেহারায় প্রকাশিত হয়ে আসছে। 

রাজনীতিতে সরকার থাকে এবং বিরোধী দল থাকে এবং দেশের উন্নয়নের ক্ষেত্রে নানান পরিকল্পনা এবং কার্যক্রম এগুতে থাকে। বাংলাদেশ বহু নদীর দেশ। তাই জলপথ যেনো আমাদের যোগাযোগ ক্ষেত্রে বাধা না-হয় সেজন্যে দ্রুত যোগাযোগ সহজতর করার জন্যে সেতু নির্মাণের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। এখানে সারা দেশে যোগাযোগের জন্যে সারাবছর স্থলে এক শহর থেকে অন্য শহরে যোগাযোগ উন্নত হচ্ছে। সড়কের পাশাপাশি নদীর দিকে মনোযোগ দিয়েছেন এপর্যন্ত সকল সরকার। ছোটো ছোটো নদীর উপর সেতু নির্মাণের পাশাপাশি চলছে বড়ো বড়ো নদীর উপর সেতু নির্মাণ করে সারাদেশে দ্রুত যোগাযোগ সহজতর করার কাজ। বাংলাদেশের প্রধান তিনটি নদীর অন্যতম যমুনা নদীর উপর যেদিন ৪.৮ কিলোমিটার দৈর্ঘ্য বিশিষ্ট সড়ক ও রেল সেতু নির্মাণ হলো সেদিন যোগাযোগ ক্ষেত্রে বাংলাদেশের এক বিস্ময়কর উন্নয়ন দেখা গেল। ওই সেতুটি যমুনা নদীর দুই প্রান্তের মানুষের আভ্যন্তরীন পণ্য ও যাত্রী পরিবহন সহজ করে। এটি তখন দৈর্ঘ্যের দিক থেকে পৃথিবীর ১১শ এবং দক্ষিণ এশিয়ার ৬ষ্ঠ দীর্ঘতম সেতু। ১৯৯৮ খ্রীষ্টিয় সালের ২৩ জুন সেতুটি যান চলাচলের জন্যে উম্মুক্ত করে দেয়া হয়। 

যমুনা সেতু পরে বঙ্গবন্ধু সেতু নামকরণ করা হয়। স্বাধীনতার ২৭ বছরের মাথায় এতো বড়ো একটা সফলতা বাংলাদেশের জন্যে যখন গৌরবের তখনও কেউ কেউ নেতিবাচক কথা বলেছেন। কিন্তু; শেষ পর্যন্ত উন্নয়ন থামেনি। এতে 'ধ্বংসাত্মক কাজের সমর্থক' অখুশি কি-না খুঁজতে চাই না, তবে 'উন্নয়ন কার্যক্রম এর সমর্থক' খুব খুশি। এরপর দেশে অনেক উন্নয়ন হয়েছে। সবকিছু লিখে এখানে জায়গা করা যাবে না। উন্নয়নের ধারাবাহিকতায় ২০২২ খ্রীষ্টিয় সালের ২৫ জুন মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা উদ্বোধন করেন বাংলাদেশের দীর্ঘতম বহুমুখী সড়ক ও রেল সেতু — পদ্মা সেতু। এই পদ্মা সেতু নির্মাণের ক্ষেত্রে বাংলাদেশকে দেশি-বিদেশি চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে হয়েছে। এই সেতুর দৈর্ঘ্য ৬.১৫ কিলোমিটার এবং প্রস্থে এটি ১৮.১০ মিটার। বিশ্বের দীর্ঘতম সেতুগুলোর সাথে তুলনা করলে পাই, পদ্মা সেতু বিশ্বের ১২২ তম দীর্ঘ সেতু। 

এই সেতু নির্মাণে সর্বাধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার করা হয়েছে এবং বলা হয়ে থাকে পদ্মা সেতু ৯ মাত্রার ভূমিকম্প সহনীয়। পদ্মা সেতু নির্মাণকারী প্রতিষ্ঠান হচ্ছে চায়না মেজর ব্রিজ ইঞ্জিনিয়ারিং কনস্ট্রাকশন কোম্পানি। আমাদের এই পদ্মা সেতু প্রকল্পের ১১ সদস্যের বিশেষজ্ঞ প্যানেলের সভাপতি ছিলেন বাংলাদেশের অধ্যাপক জামিলুর রেজা চৌধুরী। এভাবেই বাংলাদেশের উন্নয়ন স্থলপথে ও জলপথে এগুচ্ছে।

বাংলাদেশ দুর্বার গতিতে শুধু স্থলে ও জলে উন্নয়ন করেই ক্ষান্ত হয়নি। দুনিয়ার বিশেষ কয়েকটি উন্নত দেশের সাথে তাল মিলিয়ে বাংলাদেশ আকাশ পথেও মহাকাশে ডানা মেলতে চাইলো এবং একদিন বাংলাদেশের পতাকা মহাকাশের পথে উড়ে গেল বিজয়ী বাংলাদেশ হিসেবে। ২০১৮ খ্রীষ্টিয় সালের ১১মে, বাংলাদেশ সময় ১২মে আমেরিকা থেকে বঙ্গবন্ধু - ১ নামের স্যাটেলাইট উৎক্ষেপণ করা হয়। এর মাধ্যমে নিজস্ব স্যাটেলাইট উৎক্ষেপণকারী দেশ হিসেবে ৫৭ তম দেশ হিসেবে বাংলাদেশের নাম যোগ হয় বিশ্বের স্যাটেলাইট উৎক্ষেপণকারী দেশের তালিকায়। বাংলাদেশের মানুষ জানলো, সারা দুনিয়ার 'উন্নয়ন কার্যক্রম এর সমর্থক' মানুষ জানলো বাংলাদেশ আকাশের পথে মহাকাশ বিজয়ী দেশ। এরপর কি থেমে থাকতে পারে!

 উন্নয়নের চোখ এবার পাতালে। আমাদের বাংলাদেশের মাটির নীচ দিয়েও চলবে উন্নয়নের গাড়ি, চলবে বাংলাদেশের মানুষ। বিদেশে বিলেতের পাতালে গাড়ি চলে — এমন গল্প শুনে বিস্মিত হয়েছে যে দেশের মানুষ তাদের নিজেদের দেশেই এখন পাতালে গাড়ি চলে! স্বাধীনতা অর্জনের মাত্র বায়ান্ন বছরের মধ্যে বাংলাদেশ পাতাল বিজয় করেছে। ২০২৩ খ্রীষ্টিয় সালের ২৮ অক্টোবর দেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা উদ্বোধন করেন বঙ্গবন্ধু টানেল। এই টানেলটি বাংলাদেশের চট্টগ্রামের কর্ণফুলী নদীর তলদেশে হয়েছে। এটি নিসন্দেহে বাংলাদেশের এক বড়ো সফলতা। কারণ, এটি দক্ষিণ এশিয়ার কোনো নদীর তলদেশ দিয়ে যানবাহন চলাচলকারী প্রথম টানেল। এখানেই শেষ নয়, আমাদের বিমানবন্দর সমূহ এবং রেলস্টেশন সমূহ আরও উন্নত হচ্ছে এবং কক্সবাজার সহ দেশের নতুন নতুন জেলায় রেলপথ যোগাযোগ বাড়ানো হচ্ছে।

অনেককেই দেশের ভবিষ্যৎ চিন্তায় হতাশ দেখতে পাওয়া যায়। এখানে রাজনৈতিক অস্থিরতা আছে। উন্নয়ন স্থায়ী রূপ পেতে রাজনৈতিক স্থিতিশীলতার প্রয়োজন রয়েছে। নিজেদের ভালো কাজকে সামনে নিয়ে আসলে হতাশা কেটে যায় এবং এখান থেকে আরও উন্নতির দিকে অনুপ্রেরণা জাগে। বাংলাদেশের একজন 'উন্নয়ন কার্যক্রম এর সমর্থক' হিসেবে আমার আবেগ খুবই ইতিবাচক। জনগণের সমর্থন নিয়ে রাষ্ট্র পরিচালনায় সরকারে যখন যারাই থাকবেন আমরা আমাদের দেশের উন্নয়ন দেখতে চাই। যারা সরকারে ও বিরোধী দলে থাকবেন তাদেরকে আমরা মানুষের জীবন মানের উন্নয়ন কাজে দেখতে চাই।
 
লেখক - মোহাম্মদ আব্দুল হক, কলামিস্ট ও প্রাবন্ধিক