শুরুতে বলি, বাংলাদেশের রাজনীতিতে আলোচিত নির্বাচনকালীন নিরপেক্ষ সরকার প্রসঙ্গ নতুন নয় এবং প্রথমবার যখন নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে জাতীয় সংসদ নির্বাচন হয়েছিলো তখনও এটা সংবিধানে ছিলো না। কিন্তু জনগণের ইচ্ছার বাস্তবায়ন হয়েছিলো। এখন আলোচনা এগিয়ে নেয়া যাক বর্তমান প্রেক্ষাপট নিয়ে। বাংলাদেশের মানুষের মাঝে ডিসেম্বর শব্দটা বাঙালির কাছে বিজয়ের এক শব্দের রূপে ধরা দেয়। যখন জাতীয় সংসদ নির্বাচন ঘিরে দেশের রাজনীতি নানান দলের নানান কর্মসূচিতে তরঙ্গায়িত সময় এই ডিসেম্বরে এসে যায়, তখন এই ডিসেম্বর আরও অধিক গুরুত্বপূর্ণ আলোচনায় উঠে আসে।

 


এই মাসে বাঙালি জাতি সংক্ষিপ্ত ইতিহাস খুঁজে এবং ১৯৪৭ খ্রীষ্টিয় সাল থেকে ঘুরে আসে। ব্রিটিশ শাসনাধীন বৃহত্তর ভারত বিভক্ত হয়ে যায় দ্বিজাতিতত্ত্বের ভিত্তিতে এবং বর্তমান বাংলাদেশ (তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান) ভূখণ্ড নিয়ে পাকিস্তান রাষ্ট্রের সৃষ্টি হয়। পাকিস্তান সৃষ্টির সূচনা থেকে অত্যধিক উর্দু ভাষার প্রীতি থেকে শুরু হয় প্রথমে বাংলা ভাষার উপর পশ্চিম পাকিস্তানের আক্রোশ এবং এরপর চলে নানান ভাবে বাঙালি জাতির উপর শোষণ। বাঙালি সব অত্যাচারের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়িয়ে এবং ধারাবাহিক ভাবে একের পর এক সংগ্রামে জয়ী হয়ে পর্যায়ক্রমে মাওলানা ভাসানী, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে চূড়ান্ত সংগ্রামে ১৯৭১ খ্রীষ্টিয় সালে উপনীত হয়। 

এবছর ৭মার্চ ঐতিহাসিক সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে জনসভায় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ভাষণে বলেন, '... যার কাছে যা কিছু আছে তাই নিয়ে শত্রুর মোকাবেলা করতে হবে।' এরপর বঙ্গবন্ধুকে গ্রেফতার ও ২৫মার্চ রাতে পাকিস্তানি মিলিটারি হানাদার বাহিনী তাদের অস্ত্র নিয়ে ঢাকার মানুষের উপর গুলি করে এবং মানুষ মারে। এরই প্রেক্ষিতে ২৬মার্চ প্রথম প্রহরে বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতার ঘোষণা প্রচারের পরে প্রকৃত সংগ্রাম শুরু হয়। আমাদের মুক্তিযুদ্ধের সময় তখন ভারত, তৎকালীন সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্র সোভিয়েত ইউনিয়ন সহ অনেক দেশ আমাদের সমর্থন করে এবং বিভিন্ন দেশের প্রগতিশীল মানুষও তখন বাংলাদেশের জনগণের স্বাধীনতার সংগ্রামকে সমর্থন করে। 

নির্যাতিত নিপীড়িত বাঙালির নেতা শেখ মুজিবুর রহমান ধারাবাহিক ভাবে নেতৃত্ব দিয়ে বাঙালিকে একটি প্রকৃত মুক্তিযুদ্ধের দিকে নিয়ে যান। ভাষা আন্দোলন ১৯৫২, তারপর ১৯৫৪ সালে যুক্তফ্রন্ট নির্বাচনে জয়লাভ, ১৯৫৮'র মার্শাল ল বিরোধী আন্দোলন, ১৯৬২'র শিক্ষা কমিশন বিরোধী আন্দোলন, ১৯৬৬'র ছয়দফা আন্দোলন, ১৯৬৮'র আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা, ১৯৬৯'র গণঅভ্যুত্থান হচ্ছে বাঙালির আত্ম পরিচয়ের একেকটি ঐতিহাসিক ঘটনার মাইলস্টোন। এরপর ১৯৭০ খ্রীষ্টিয় সালের সাধারণ নির্বাচনে বিপুল জয়ের মাধ্যমে বাঙালির নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানই বাংলাদেশের মুক্তিকামী মানুষের একমাত্র নেতা। ২৫মার্চ ১৯৭১ রাতে বঙ্গবন্ধুকে গ্রেফতার করে বন্দী করে নেয় কারাগারে। তাই তখন বঙ্গবন্ধু দেশের মাটিতে সশরীরে উপস্থিত না-থাকলেও তাঁকেই রাষ্ট্রপতি করে গঠিত হয় বাংলাদেশ সরকার।

 

এই সরকারের অধীনে মুক্তিযুদ্ধের প্রধান সেনাপতি বঙ্গবীর জেনারেল এমএজি ওসমানীর বিচক্ষণতায় সমগ্র বাংলাদেশকে এগারোটা সেক্টরে ভাগ করে সশস্ত্র সংগ্রামের মাধ্যমে দীর্ঘ প্রায় নয় মাস পরে ওই বছর ১৬ ডিসেম্বর পৃথিবীতে বাংলাদেশ নামক নতুন এক স্বাধীন রাষ্ট্রের অভ্যূদয় হয়। ওই সংগ্রামের সময় ত্রিশ লক্ষ শহীদের প্রাণদান ও দুই লক্ষ নারীর সম্ভ্রম হারানো আমাদের কাছে শ্রদ্ধার সাথে স্মরণীয়। কারণ, তাঁদের ত্যাগের বিনিময়ে মুক্তি পায় বাঙালি জাতি জেগে উঠে স্বাধীন বিজয়ী বাংলাদেশ। সেই থেকে প্রতিবছর ১৬ ডিসেম্বরের শুরুতে ৩১ বার তোপধ্বনির মাধ্যমে বিজয় দিবসের উৎসব পালন শুরু হয়। ৩১ বার তোপধ্বনি দেওয়ার বিষয়টি আন্তর্জাতিক স্বীকৃত। আমাদের দেশেও জাতির শ্রেষ্ঠ সন্তানদেরকে বীর মুক্তিযোদ্ধাদেরকে ৩১ বার তোপধ্বনির মাধ্যমে স্বাধীনতা দিবস ও বিজয় দিবসে সম্মান জানানো হয়। তবে তোপধ্বনি সংখ্যা ক্ষেত্রবিশেষে কমবেশি হতে পারে। বাংলাদেশের সুবর্ণজয়ন্তী উপলক্ষে স্বাধীনতা দিবস ও বিজয় দিবসে ৩১ বারের পরিবর্তে ৫০ বার তোপধ্বনির মাধ্যমে উৎসব শুরু হয়।

এবছর বাংলাদেশের মানুষের কাছে বিজয় দিবসে নতুন মাত্রা যোগ হয়েছে, 'দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন'। ১৫ নভেম্বর ২০২৩ সন্ধ্যা ৭টায় প্রধান নির্বাচন কমিশনার কাজী হাবিবুল আউয়াল জাতির উদ্দেশ্যে দেয়া ভাষণের মাধ্যমে দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের তফসিল ঘোষণা করেছেন। নির্বাচনের তফসিলে সাধারণত নির্বাচনে প্রার্থীর মনোনয়ন পত্র জমার তারিখ, বাছাই, রিটার্নিং কর্মকর্তার সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে আপিল ও শুনানির তারিখ, মনোনয়ন পত্র প্রত্যাহারের শেষ তারিখ, প্রতীক বরাদ্দ, নির্বাচনী প্রচারের সময়সীমা এবং নির্বাচনের নির্দিষ্ট তারিখ উল্লেখ করা হয়। এপর্যন্ত ঘোষিত তফসিল অনুযায়ী বাংলাদেশের দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন হবে ৭ জানুয়ারি ২০২৪। তাই এ বছরের শেষ সময়ে এসে নির্বাচনের আগে বাংলাদেশের রাজনীতির মাঠ উত্তাল। বাংলাদেশের প্রধান দুই রাজনৈতিক দলের একটি বর্তমানে টানা পনেরো বছর ধরে সরকারে থাকা বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ এবং অন্যটি দীর্ঘদিন ধরে নির্দলীয় নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে নির্বাচন দাবি করে আসছে প্রধান বিরোধী দল বিএনপি।

 

বাংলাদেশে নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে নির্বাচনের দাবি নতুন নয়। বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে আট দলীয় জোট, বিএনপির নেতৃত্বে সাত দলীয় জোট এবং বামপন্থী পাঁচ দলীয় জোটের আন্দোলনের মুখে ১৯৯০ সালে সামরিক শাসক জেনারেল এইচ এম এরশাদ ক্ষমতাচ্যুত হবার পরে, ১৯৯১ খ্রীষ্টিয় সালে অনুষ্ঠিত পঞ্চম জাতীয় সংসদ নির্বাচন বাংলাদেশের ইতিহাসে প্রথম বারের মতো নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে হয়েছিলো। উল্লেখ্য, নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে জাতীয় সংসদ নির্বাচন বাংলাদেশের সংবিধানের অংশ তখনও ছিলো না। কিন্তু তখন সবগুলো রাজনৈতিক দল বিশেষ করে যারা বৃহৎ জনগোষ্ঠীকে নেতৃত্ব দিচ্ছেন তাদের সকলের সম্মতির ভিত্তিতে সেটা হয়েছিলো। এবার পরিস্থিতি ভিন্ন। আওয়ামী লীগ, জাসদ, ওয়ার্কার্স পার্টি, তরিকত ফেডারেশন, জাতীয় পার্টি সংবিধান অনুযায়ী নির্বাচনের পক্ষে। 

উল্লেখ্য দেশে প্রথম বারের মতো ১৯৯১ সালে নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে নির্বাচনে বিএনপি জয়লাভ করে এবং বেগম খালেদা জিয়া হন বাংলাদেশের প্রথম মহিলা প্রধানমন্ত্রী। লক্ষণীয়, সেবছর সারা দুনিয়ায় প্রসংশা পেলেও তখনও পরাজিত পক্ষ সন্তুষ্টি প্রকাশ করেনি। বাংলাদেশে সংবিধান অনুযায়ী নির্বাচন কিংবা নির্দলীয় নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে নির্বাচন যা-ই হয়েছে এপর্যন্ত, পরবর্তীতে পরাজিত দল কি হাসিমুখে জনগণের রায় মেনে নিয়েছে কখনও? বিবিসি'র বরাত দিয়ে জানা যায়, 'বাংলাদেশের বড়ো দুই রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগ ও বিএনপি যখনই পরাজিত হয়েছে, তখন তারা নির্বাচনের ফলাফল মেনে নেয়নি। বাংলাদেশে এপর্যন্ত যেসব নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছে সেগুলোর ফলাফল নিয়ে পরাজিত পক্ষ সবসময় নাখোশ ছিলো।' 

প্রতিবারের ন্যায় এবারও বাংলাদেশের নির্বাচন ঘিরে বিদেশি কূটনীতিকদের দৌড় ও কথাবার্তা চলছে। সাধারণ মানুষ আশা করে আওয়ামী লীগ, বিএনপি সহ সকল দলের অংশ গ্রহণে জাতীয় সংসদ নির্বাচন হবে। প্রধান দুই রাজনৈতিক দলের অংশ গ্রহণ খুবই জরুরি দেশের উন্নয়ন গতিশীল রাখার জন্যে এবং গণতান্ত্রিক স্থিতিশীল পরিস্থিতির জন্যে। আজ দেশ যেটুকু উন্নত হয়েছে তা দেশের মানুষের শারীরিক শ্রম ও মেধার ফসল। সাধারণ মানুষ কষ্ট করে, কর্ম করে দেশে ও দেশের বাইরে উদ্বিগ্ন সময় কাটায় নির্বাচন ঘিরে রাজনৈতিক অস্থিরতায়। তাই যেহেতু মানুষের জন্যেই রাজনীতি, তাহলে কল্যাণ চাইলে সরকারি দল ও বিরোধী দল উভয় পক্ষই ত্যাগী মনোভাব নিয়ে দেশের মানুষের মঙ্গলের স্বার্থে রাজনীতি করার দৃঢ় শপথ নিতে হবে ত্রিশ লক্ষ শহীদের আত্মত্যাগকে স্মরণ করে। নিঃসন্দেহে সরকারের দায় অধিক। কারণ, রাজনীতিতে একটি কথা মনে রাখতে হবে, যা-ই ঘটুক না-কেন নেতৃত্বকে দায় নিতে হবে। বিজয়ে ও নির্বাচনে — বিশৃঙ্খলা নয় সুশৃঙ্খল রাজনীতি — এই হোক আমাদের দৃঢ় অঙ্গীকার।

 

বাঙালি প্রতি বছর স্বাধীনতা দিবস, বিজয় দিবস উৎসব পালন করে। তবে; একটা বিষয় বাঙালির মনে ঘৃণাভরে গেঁথে আছে, তা-হলো, বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামে বিরোধিতাকারী এদেশীয় বিভিন্ন দল, কতিপয় ব্যক্তির কুৎসিত ভূমিকা ও তৎকালীন বিভিন্ন রাষ্ট্রের নেতিবাচক ভূমিকা। এটা থাকবে। পাশাপাশি ওই সময়ে দেশি-বিদেশি লেখক, সাংবাদিক, শিল্পী এবং বিভিন্ন রাষ্ট্রের আন্তরিকতা শ্রদ্ধার সাথে স্মরণ করে। এসব মনে রাখতে হয়, আর এজন্যেই বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাসের খোঁজ নিতে হয়। বাঙালির একটি স্বতন্ত্র দেশ বাংলাদেশ এমনি এমনি হয়ে উঠেনি। বাংলাদেশের রাজনীতি সচেতন সকলকে সবসময় আমাদের ভাষা আন্দোলন, ১৯৭০ খ্রীষ্টিয় সালের সাধারণ নির্বাচন, রেসকোর্স ময়দানে ৭মার্চের ঐতিহাসিক ভাষণ, কালুরঘাট বেতারকেন্দ্র থেকে স্বাধীনতার ঘোষণা, স্বাধীনতা দিবস, বিজয় দিবস এবং স্বৈরশাসনের বিরুদ্ধে গণতান্ত্রিক সমাজতান্ত্রিক আন্দোলনের ইতিহাস খুঁজে রাখতে হবে, তা না-হলে আমাদেরকে অর্থনৈতিক, সামাজিক ও রাজনৈতিক পশ্চাৎপদতার পাঁকে হাবুডুবু খেতে হবে বারবার।

 

লেখক-মোহাম্মদ আব্দুল হক, কলামিস্ট ও সাহিত্যিক