বাংলাদেশ এই পৃথিবীর বুকে স্বাধীন সার্বভৌম একটি রাষ্ট্র। তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের জনগণ এ অঞ্চলের নেতা শেখ মুজিবুর রহমানের নির্দেশে ১৯৭১ খ্রীষ্টিয় সালের ২৬ মার্চ তৎকালীন পাকিস্তান রাষ্ট্রের শাসকদের বিরুদ্ধে সরাসরি যুদ্ধে ঝাপিয়ে পড়ে। শেখ মুজিবুর রহমান পাকিস্তানের কারাগারে বন্দী। তখন যুদ্ধ পরিচালিত হয় বঙ্গবীর জেনারেল এমএজি ওসমানী 'র নেতৃত্বে এগারোটি সেক্টরের সেক্টর কমান্ডারদের সাহসী ও বুদ্ধিদীপ্ত রণকৌশলে। যুদ্ধে জড়ায় ছাত্র, কৃষক, শ্রমিক ও সাহসী তরুণ - তরুণী।

 


দীর্ঘ নয় মাসের যুদ্ধে প্রায় ত্রিশ লক্ষ মানুষ শহীদ হয় পাকিস্তানি মিলিটারি ও পূর্ব পাকিস্তানে গড়ে উঠা জামাতে ইসলামের রাজাকার, আলবদর ও আল-শামস বাহিনীর হাতে। ওই নয় মাসের যুদ্ধে প্রায় দুই লক্ষ বাঙালি তরুণী ও মহিলা পাকিস্তানি মিলিটারি ও তাদের সহচর হিসেবে সহযোগিতাকারী জামাতে ইসলামের বাহিনীর হাতে নির্যাতনের শিকার হয় ধর্ষিতা হয়। এদিকে বাংলাদেশের বীর মুক্তিযোদ্ধারা বিজয়ের নেশায় মরণপণ করে শত্রুর বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে। এরপর ১৯৭১ খ্রীষ্টিয় সালের ১৬ ডিসেম্বর পৃথিবীতে বাংলাদেশ নামের নতুন এক রাষ্ট্রের জন্ম হয়। 

 

এই হচ্ছে সংক্ষিপ্ত আকারে সত্য ইতিহাস। কিন্তু ; এতো সহজে আসেনি বাংলাদেশের বিজয়। মাতৃরাষ্ট্রের বিরুদ্ধে শুধু যুদ্ধ করলেই বিজয় আসে না, বরং ; একটি স্বাধীন রাষ্ট্রের জন্যে প্রয়োজন হয় আন্তর্জাতিক স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্রের সমর্থন বা স্বীকৃতি। একটি নেতৃত্ব কাঠামোও প্রয়োজন হয়। তখন যুদ্ধ চলাকালীন পাকিস্তানের কারাগারে বন্দী বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে রাষ্ট্রপ্রধান করে, অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম ও প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দিন আহমদের নেতৃত্বে গঠিত মুজিব নগর সরকারকে বাংলাদেশের পক্ষে সমর্থন আদায়ের জন্যে বিভিন্ন দেশে চিঠি লিখে কুটনৈতিক যোগাযোগ রক্ষা করতে হয়েছে। তখন এমএজি ওসমানীকে মুক্তিবাহিনীর প্রধান সেনাপতি করা হয়। এ বিষয়ে আমাদেরকে সচেতন ভাবে জেনে রাখা জরুরি। আমাদের স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাসের আলোচনার পাশাপাশি আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি পাওয়ার ব্যাপারটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ।

একটা সময় ভারত, পাকিস্তান ও বাংলাদেশ ভূখণ্ড বৃটিশ উপনিবেশ বা colony ছিলো, অর্থাৎ এ অঞ্চল বৃটিশদের নিয়ন্ত্রণে ছিলো। ১৯৪৭ খ্রীষ্টিয় সালে ভারত ও পাকিস্তান দুটি পৃথক রাষ্ট্রের সৃষ্টির মাধ্যমে আমরা প্রথম স্বাধীন হয়েছিলাম ব্রিটিশ - ভারতের বৃটিশ শাসনের দাসত্ব থেকে। কিন্তু ; দুঃখজনক হলেও সত্য প্রায় দুই শত বছরের বৃটিশ শাসনের পর আমরা পাকিস্তান রাষ্ট্রের শাসকদের দ্বারা নির্যাতিত হতে থাকি। এখানে আমাদেরকে প্রথমেই মাতৃভাষায় পড়া লেখা ও কথা বলার অধিকার আদায়ের জন্যে আন্দোলন করতে হয় ১৯৪৮ খ্রীষ্টিয় সাল থেকেই। এরপর অনেক প্রতিবাদ ও আন্দোলন করে সালাম বরকত রফিক জব্বারের আত্মত্যাগের শেষে ১৯৫২ খ্রীষ্টিয় সালের ২১ ফেব্রুয়ারী আমাদের মাতৃভাষার অধিকার প্রতিষ্ঠিত হয়। কিন্তু ; তৎকালীন পাকিস্তানের রাষ্ট্র ক্ষমতায় নেতৃত্বে পশ্চিম পাকিস্তানের নেতা ও মিলিটারিদের প্রাধান্য ছিলো বেশি এবং পূর্ব পাকিস্তানের বিশেষ করে বাঙালিদের অংশ গ্রহণ খুবই কম ছিলো। তাই পাকিস্তান রাষ্ট্রের সৃষ্টির শুরু থেকেই পশ্চিম পাকিস্তানের শাসক শ্রেণির ষড়যন্ত্র চলতে থাকে পূর্ব পাকিস্তানের বাঙালিদের প্রতি। 

পূর্ব পাকিস্তান ও পশ্চিম পাকিস্তান দুই অংশ নিয়ে এক পাকিস্তান হলেও পশ্চিম পাকিস্তানের শাসক গোষ্ঠী রাষ্ট্রের সড়ক উন্নয়ন, শিক্ষা উন্নয়ন, নতুন নতুন শিল্প কারখানা গড়ে তোলার ক্ষেত্রে পশ্চিম পাকিস্তানের দিকেই অধিক মনোযোগ দিতে থাকে এবং শিক্ষা ও সংস্কৃতির বিকাশে, নতুন নতুন রাস্তা তৈরি করে সড়ক যোগাযোগ বাড়াতে, শিল্প কারখানা ইত্যাদি গড়ে তোলতে, এমনকি সরকারি চাকরিতে নিয়োগের ক্ষেত্রেও বাঙালিদেরকে পিছিয়ে রাখতো সচেতন ভাবে। এরই প্রেক্ষিতে বায়ান্নর রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনের পরে ধারাবাহিক ভাবে ১৯৬৬, ১৯৬৯ খ্রীষ্টিয় সালের ঐতিহাসিক আন্দোলন, ১৯৭০ খ্রীষ্টিয় সালের সাধারণ নির্বাচনে বিজয়, ১৯৭১ খ্রীষ্টিয় সালের ৭ মার্চের ভাষণ শেষে এ অঞ্চলের নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ডাকে ১৯৭১ সালে বাংলার জনগণ স্বাধীন বাংলাদেশ ভূখণ্ডের জন্যে পাকিস্তানি মিলিটারি ও তাদের এ দেশীয় দোসর দালালদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে। এই যুদ্ধে লক্ষ লক্ষ মানুষ জীবন দিয়েছে। প্রায় এককোটি শরনার্থী ভারতে আশ্রয় পেয়েছে। ভারতের সরকার আমাদের মুক্তিযোদ্ধাদেরকে অস্ত্র ও ট্রেনিং দিয়েছে। যুদ্ধ চলছে সারা বাংলাদেশের সর্বত্র। তারপরও ডিসেম্বর মাসের ৫ তারিখ পর্যন্ত আমরা বহির্বিশ্ব থেকে বাংলাদেশের স্বাধীনতার পক্ষে প্রয়োজনীয় সমর্থন পাইনি। অবশেষে আসে সেই শুভ সময়। ১৯৭১ খ্রীষ্টিয় সালের ৬ ডিসেম্বর সকালে ভূটান থেকে পাই প্রথম স্বীকৃতি। তৎকালীন ভূটানের রাজা জিগমে দর্জি ওয়াংচুক বার্তা পাঠিয়ে বলেন, ' বিদেশি দখলদার বাহিনীর বিরুদ্ধে স্বাধীনতা লাভের জন্যে বাংলাদেশের জনগণের মহান এবং বীরত্বপূর্ণ সংগ্রাম অদূর ভবিষ্যতে সাফল্য লাভ করবে। 

ভুটানের জনগণ ও তার প্রত্যাশা, সৃষ্টিকর্তা বর্তমান বিপদ থেকে বঙ্গবন্ধুকে মুক্ত করবেন, যাতে তিনি দেশের পুনর্গঠন ও উন্নয়নের মহান কর্তব্যে দেশ ও দেশের মানুষকে নেতৃত্ব দিতে পারেন। আমাদের জন্যে আরও আনন্দ সংবাদ আসে, ওইদিন-ই সকাল ১১ টার দিকে ভারতের অল ইন্ডিয়া রেডিও-তে ভারত সরকারের পক্ষে বাংলাদেশকে একটি স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্র হিসেবে স্বীকৃতি দানের ঘোষণা দেয়া হয়। ভারতের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী ভারতের পার্লামেন্টের বিশেষ অধিবেশন আহবান করে বলেন, ' বাংলাদেশের সব মানুষের ঐক্যবদ্ধ বিদ্রোহ এবং সেই সংগ্রামের সাফল্য এটা ক্রমান্বয়ে স্পষ্ট করে তুলেছে যে তথাকথিত মাতৃরাষ্ট্র পাকিস্তান বাংলাদেশের মানুষকে স্বীয় নিয়ন্ত্রণে ফিরিয়ে আনতে সম্পূর্ণ অসমর্থ।' 


ইন্দিরা গান্ধী আরো বলেন, ' স্বাধীনতা আন্দোলনের ইতিহাসে বিশাল বাধার বিরুদ্ধে বাংলাদেশের জনগণের সংগ্রাম এক নতুন অধ্যায় রচনা করেছে। সতর্কতার সঙ্গে বিবেচনা করার পর বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে ভারত।' ভারতের পার্লামেন্টে সেদিন ৬ ডিসেম্বর প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী'র বক্তব্য শেষ হওয়ার সাথে সাথে ভারতের সংসদ সদস্যরা আনন্দের আওয়াজ তোলেন এবং ' জয় বাংলাদেশ ' ধ্বনি দিয়ে তাদের পার্লামেন্ট মুখরিত করে তোলেন। ভারতের মতো বৃহৎ গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের স্বীকৃতি পাওয়ার পরে প্রকৃত অর্থে বহির্বিশ্বের নজর কাড়ে নতুন দেশ হিসেবে বাংলাদেশ।

প্রিয় পাঠক, বাংলাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলনের ইতিহাসে আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি পাওয়ার গুরুত্বের কথা এই নিবন্ধের সূচনায় উল্লেখ করেছি। জেনে রাখতে হবে, একটি দেশের জনগণের যৌক্তিক স্বাধীনতা সংগ্রামের পাশাপাশি আন্তর্জাতিক সমর্থন আদায় জরুরি হয়ে উঠে। ১৯৭১ খ্রীষ্টিয় সালের ৬ ডিসেম্বর প্রথমে ভূটান ও পরে ভারতের স্বীকৃতি পাওয়ার পরে বাংলাদেশের জনগণের স্বাধীনতা সংগ্রাম নতুন মাত্রা লাভ করে। পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী মানসিক ভাবে দুর্বল হয়ে পড়ে এবং আমাদের মুক্তি বাহিনী দ্বারা একে একে বাংলাদেশের বিভিন্ন অঞ্চল শত্রু মুক্ত হতে থাকে। ওইদিন-ই পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী যশোর সেনানিবাস ছেড়ে পালিয়ে যায় এবং যশোরেই যুদ্ধ বিজয়ী বাংলাদেশের রক্ত-রাঙা সূর্য আঁকা সবুজ পতাকা প্রথমে উড়েছিলো। ওই ৬ ডিসেম্বরে তৎকালীন সিলেট জেলার সুনামগঞ্জ মুক্ত হয় ও বিভিন্ন এলাকা বিজয়ের ধারাবাহিকতায় ১৬ ডিসেম্বর ১৯৭১ খ্রীষ্টিয় সালে ঢাকায় পাকিস্তান সেনাবাহিনী নির্লজ্জ ভাবে আত্মসমর্পণ করে। বাংলাদেশ স্বাধীন হয়। কিন্তু; ওই বছর আর কোনো রাষ্ট্র বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেয়নি।

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান পাকিস্তান কারাগার থেকে মুক্ত হয়ে স্বাধীন বাংলাদেশে আগমনের পরে ১৯৭২ খ্রীষ্টিয় সালের ১১ জানুয়ারি তৎকালীন পূর্ব জার্মান বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেয়। একই বছর ১২ জানুয়ারি পোল্যন্ড ও বুলগেরিয়া, ১৩ জানুয়ারি মিয়ানমার, ১৬ জানুয়ারি অষ্ট্রেলিয়া ও নিউজিল্যান্ডের স্বীকৃতি পায় বাংলাদেশ। বৃহৎ দেশ রাশিয়া সহ তৎকালীন সমাজতান্ত্রিক সোভিয়েত ইউনিয়ন ২৪ জানুয়ারি স্বীকৃতি দেয় বাংলাদেশকে। স্বাধীন বাংলাদেশকে গ্রেট বৃটেন স্বীকৃতি দেয় ১৯৭২ খ্রীষ্টিয় সালের ৪ ফেব্রুয়ারি। মুসলিম দেশসমূহের মধ্যে প্রথমে মালয়েশিয়া ও ইন্দোনেশিয়া ওই বছর ২৫ ফেব্রুয়ারি বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেয়। একই বছরের ৪ এপ্রিল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নিকট থেকে স্বীকৃতি মিলে। প্রথম আরব দেশ হিসেবে ইরাক ১৯৭২ খ্রীষ্টিয় সালের ৮ জুলাই বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেয়। বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে কুটনৈতিক তৎপরতায় বিভিন্ন দেশের স্বীকৃতি আসতে থাকে। এভাবে ধারাবাহিক ভাবে ১৯৭৩ খ্রীষ্টিয় সালে বাংলাদেশকে স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্র হিসেবে স্বীকৃতি দেয় মোট ১৮ টি দেশ। যে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে আমরা স্বাধীন বাংলাদেশ পেয়েছি, সেই পাকিস্তান ১৯৭৪ খ্রীষ্টিয় সালের ২২ ফেব্রুয়ারি স্বাধীন বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেয়। আজকে চীন ও সৌদি আরবের সঙ্গে আমাদের যে নানান উন্নয়ন বিষয়ক কর্মকাণ্ডের সম্পর্ক, সেই চীন ও সৌদি আরব ১৯৭৫ খ্রীষ্টিয় সালের আগষ্টের আগে স্বীকৃতি দেয়নি। কিন্তু; কুটনৈতিক যোগাযোগ চলে এবং সৌদি আরব বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেয় ১৯৭৫ খ্রীষ্টিয় সালের ১৫ আগষ্ট বঙ্গবন্ধু হত্যার পরের দিন অর্থাৎ ১৬ আগষ্ট। বৃহৎ সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্র চীন বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেয় ১৯৭৫ খ্রীষ্টিয় সালের ৩১ আগষ্ট। এভাবেই আমরা সকল দেশ থেকে স্বাধীন দেশ হিসেবে স্বীকৃতি পাই।

একটি নতুন স্বাধীন দেশের অবকাঠামো ও শিক্ষা, চিকিৎসা, কৃষি, শিল্প কারখানার ইত্যাদি উন্নয়নের জন্যে বিভিন্ন দেশের সাথে বহুমুখী সম্পর্কে জড়াতে হয়। আর সম্পর্কে জড়াতে হলে ওইসব দেশের পক্ষ থেকে নতুন দেশের স্বীকৃতি পাওয়ার বিকল্প নেই। আমাদের দেশের বিভিন্ন সরকারের ধারাবাহিক কুটনৈতিক তৎপরতায় এখন আমরা বিশ্বের বিভিন্ন দেশের মতো আত্মমর্যাদা নিয়ে আছি স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশ হিসেবে।

 

 লেখক- মোহাম্মদ আব্দুল হক, কলামিস্ট ও সাহিত্যিক