সকালে ঘুম ভাঙে পাখির ‘কিচিরমিচির’ ডাকে। জীর্ণশীর্ণ বসত ঘরের মেঝেতে এলোপাতারি পড়ে আছে গাছের সবুজ-শুকনো পাতা।

ঘুম থেকে উঠে চা-নাস্তা করে বের হন জীবিকার অন্বেষায়। সম্বল জংধরা পুরনো বাইসাইকেল ও সেই সাইকেলে বাঁধা নানা প্রজাতির গাছের কচি চারা। দু’চাকার প্যাডেলে চাপ দিয়ে ছুটে বেড়ান এই গ্রাম থেকে ওই গ্রাম। কখনো আবার শহরের অলিগলিতে ঘুরে বেড়ান মনের গহীন স্বপ্ন নিয়ে। দিনের আলো যেখানে নিভু নিভু সেখানেই (হাট-বাজার) বসে পড়েন বাইসাইকেল ঘেঁষে। উদ্দেশ্য, স্বল্প মুনাফায় গাছের চারা বিক্রি করা।


আব্দুর রহমান। বয়স সবে ৩৫ পেরিয়েছে। স্থানীয়রা তাকে ‘বৃক্ষবন্ধু’ নামে চিনেন। মৌলভীবাজার জেলার কুলাউড়ার কর্মধা ইউনিয়নের হাসিমপুরে তার বসবাস।

তিনি ১৩ বছর সৌদিআরবে প্রবাস জীবন কাটিয়ে ৩ বছর আগে দেশে ফিরে আসেন। এরপর থেকেই তিনি বৃক্ষতে সন্ধি বেঁধেছেন আপন মনে। বেশীরভাগ ক্ষেত্রে বিভিন্ন নার্সারী থেকে গাছের চারা ক্রয় করে তা বিক্রি করেন অন্যের কাছে। চারাগুলোর মধ্যে রয়েছে বনজ, ফলজ, ঔষধী ও ফুলের গাছ।

পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষায় গাছের বিকল্প নেই। বর্তমানে বড় বড় গাছ কেটে সাবাড় করে ফেলছেন অনেকে। এতে নানারকম প্রাকৃতিক দূর্যোগের মুখোমুখি হচ্ছে দেশ। এই বিষয়টির উপলব্দি থেকেই অন্যকে গাছ লাগাতে উৎসাহ দিতে মূলত তিনি এই পেশাকে গ্রহণ করেছেন। মানুষকে গাছের চারা রোপণে আগ্রহী করে তুলতে তিনি অনেকটা চ্যালেঞ্জ হিসেবে নিয়েছেন বলে জানান। তার ধারণা, মানুষ গাছের চারা সংগ্রহ করতে চায় না কিন্তু কাছে পেলে তা কিনে নেয় সহজে।

জানা যায়, আব্দুর রহমান মাসের প্রায় প্রতিদিন কুলাউড়া উপজেলার বিভিন্ন গ্রামে গাছের চারা নিয়ে যান। চারাগুলো বাইসাইকেলে বেধে গড়ে ৩০-৪০ কি.মি. এলাকা ঘুরেন। ফেরার পথে অবিক্রিত গাছগুলো স্থানীয় কোনো হাট-বাজারে বিক্রি করেন।

আব্দুর রহমান মনে করেন, এই ব্যবসায় নিজের লাভ কম হলেও দেশ ও সমাজের বড় উপকার হবে। অন্তত পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষা হবে। পরবর্তী প্রজন্ম একটি সুন্দর সবুজ প্রকৃতির দেখা পাবে।

নিজেকে এই পেশায় জড়িত করার পেছনের কাহিনী বলতে গিয়ে রহমান বলেন, প্রায় ১৫ বছর আগের কথা। কর্মধা উচ্চ বিদ্যালয়ে দশম শ্রেণীতে অধ্যয়নকালে পারিবারিক অস্বচ্ছলতার কারণে পড়ালেখা বন্ধ হয়ে যায়। ভাগ্য বদলের আশায় পাড়ি দেই সৌদি আরবে। জেদ্দায় একটি কোম্পানিতে প্রথমে কন্সট্রাকশনের কাজ করি। পরবর্তীতে ফোরম্যানসহ একাধিক পদে দায়িত্ব পালন করি। অনেক অর্থ রোজগার করেছি। একপর্যায়ে দীর্ঘদিন কম্পিউটার নেটওয়ার্কিংয়ের কাজ করি। কিন্তু ভাগ্যের নির্মম পরিহাস। সেখানে এক আইনি জটিলতায় পড়ে দেশে ফেরত আসতে হয়েছে।

দীর্ঘদিন কাজের মধ্যে ডুবে থাকা আব্দুর রহমান দেশে আসার পর অর্থসংকটে পড়ে যান। কিছু একটা করার ইচ্ছে জাগে মনে। গতানুগতিক কোনো কাজ বা পেশায় সম্পৃক্ত না হয়ে ভিন্ন কিছু করার পরিকল্পনা করেন। সেই চিন্তা থেকে ভ্রাম্যমান গাছ বিক্রির সিদ্ধান্ত নেন তিনি। তার মতে, গাছ মানুষের হাতে পৌঁছে দিলে সুরক্ষিত থাকবে পরিবেশ। যা থেকে ব্যক্তির পাশাপাশি সমাজ উপকৃত হবে।

অনেক বৃক্ষপ্রেমীরা তার এ কর্মকে সাধুবাদ জানান।

স্থানীয় বাসিন্দা চিকিৎসক পিটার রুরাম বলেন, বৃক্ষকে ভালোবাসি। তবে সচরাচর ভালো মানের গাছের চারা পাওয়া যায় না। কিন্তু আব্দুর রহমান এই পেশায় আসার পর প্রায়ই গাছ ক্রয়ের সুযোগ হয়। তার কর্মকে স্যালুট জানাই।

স্থানীয় বাসিন্দা জুবের আহমদ হান্নান বলেন, মৌসুম এলে অনেকেই বাজারে গাছ বিক্রি করতে আসেন। কিন্তু আব্দুর রহমান সারা বছর বাড়ি বাড়ি গিয়ে মানুষের হাতে গাছ পৌঁছে দেন। তখন কোনো গাছের চারা অবিক্রীত থাকলে তা কোনো না কোনো বাজারে বিক্রি করেই বাড়ি ফিরেন। ব্যবসায়ী বাবুল আহমদ ও লিটন আহমদসহ অনেকেই তার এই কর্মকে সাধুবাদ জানান।

সকালে মায়ের দোয়া নিয়ে বের হন আব্দুর রহমান। পুরনো জরাজীর্ণ বাইসাইকেলটির পেছনের সিটে রাখা একটি ঝুঁড়িতে শ’খানেক চারা নিয়ে দৈনিক তার পথচলা। পথে প্রান্তরে ছুঁটে চলার সময় কখনো প্রখর রোদ আবার কখনো ঝড় বৃষ্টি উপেক্ষা করে যান মানুষের দ্বারে দ্বারে।

সাত ভাইবোনের মধ্যে তিনি সবার ছোট। বাবা মারা গেছেন অনেক আগেই। ভিটা বাদে বাড়িতে যেটুকু অবশিষ্ট রয়েছে তাতে ইতোমধ্যে তিনি চারা রোপণ করে রেখেছেন।

চারা গাছ সঠিকভাবে রোপণের ক্ষেত্রে কেউ সহযোগিতা চাইলে তিনি তা রোপণ করে দেন। পরবর্তীতে রোপণকৃত চারাগুলোর পরিচর্যা ও খোঁজখবর নেন তিনি নিজে থেকেই। বৃহৎ পরিসরে একটি গাছের চারার বাগান করার ইচ্ছে আছে তার। স্বপ্ন দেখলেও তার সামর্থ্য নেই। তবে ছোট ছোট সঞ্চয় করে হলেও তিনি তার ইচ্ছে পূরণ করতে চান। আব্দুর রহমান মনে করেন, সরকারি, বেসরকারি বা ব্যক্তি পর্যায়ের কোন সহায়তা পেলে তিনি তার স্বপ্ন দ্রুত বাস্তবায়ন করতে পারবেন।


সিলেটভিউ২৪ডটকম/এসএ/এসডি-২৩