শিক্ষা বৈষম্যে সিলেট

আহমদ মোশতাক রাজা চৌধুরী


ভূমিকাঃ উন্নয়ন সূচকে সিলেট

বাংলাদেশের উত্তরপূর্ব কোনে অবস্থিত সিলেট জনপদের রয়েছে প্রায় আড়াই হাজার বছরের ইতিহাস। আধুনিক কালে এটা সবসময়েই বাংলার অন্তর্গত ছিল যদিও বঙ্গভঙ্গের কারণে স্বল্প সময়ের জন্য সিলেট আসামের সাথে সংযুক্ত হয়েছিল। অবশ্য ভারত ভাগের সময় সিলেটের একটি উল্লেখযোগ্য অংশ করিমগঞ্জ ভারতের আসাম প্রদেশের অধীনে রয়ে যায়।

শিক্ষা, কৃষ্টি, সংস্কৃতি, অর্থনীতি, রাজনীতি, নান্দনিক শোভাসহ সব দিক থেকেই সিলেট ছিল অনন্য। দুঃখজনকভাবে ১৯৬০ দশক থেকে সিলেট, বিশেষ করে শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও অর্থনীতি ক্ষেত্রে পিছিয়ে পড়তে শুরু করে। ইউনিসেফ প্রকাশিত ২০১০ সালের এক প্রতিবেদনে বাংলাদেশের বিভিন্ন জেলা এবং উপজেলাকে বঞ্চনার (‘Composite deprivation index’) নিরিখে ভাগ করে। তাদের সংজ্ঞা অনুসারে বাংলাদেশে যে আটটি জেলা সবচেয়ে বেশী বঞ্চিত তার দুটোই (অর্থাৎ সিকিভাগ) সিলেট বিভাগে। অর্থাৎ দেশের জনসংখ্যার সাত ভাগেরও কম মানুষ যে সিলেটে বসবাস করে সেখানকার অর্ধেক এলাকা বঞ্চনার শিকার। নিম্নোক্ত ছকের মাধ্যমে সিলেটের বর্তমান উন্নয়ন সঙ্কট আরও সহজভাবে বুঝা যাবে। এখানে উন্নয়নের বিভিন্ন গড় সূচকে বাংলাদেশের তুলনায় সিলেটের অবস্থান দেখানো হয়েছে। মানবিক উন্নয়নের প্রায় সবগুলো সূচকেই সিলেট বেশ পিছিয়ে আছে। একটি উল্লেখযোগ্য ব্যতিক্রম হল কন্যাবিবাহের হারে যেখানে সিলেটের অবস্থান তূলনামূলকভাবে ভাল।

 

ছকঃ সিলেটের নির্বাচিত কিছু সূচক,বাংলাদেশের (গড়) তুলনায়

সূচক

সিলেট

বাংলাদেশ (গড়)

প্রজনন হার (প্রতি নারীর জন্য)

২.৬

২.৩

পরিবার পরিকল্পনা গ্রহণের হার (প্রতি ১০০ জন দম্পতির ক্ষেত্রে)

৫৫.৪

৬১.৯

শিশু মৃত্যু (প্রতি ১০০০ জন্মে)

৫২

৪৫

মাতৃমৃত্যু (প্রতি ১,০০,০০০ জন্মে)

২১৪

১৯৬

বাড়িতে শিশু ডেলিভারির হার (%)

৬১.৫

৫০.০

উন্নত স্যানিটেশন (%)

৫৮.৮

৬৫.৫

মেয়েদের প্রথম বিবাহে গড় বয়স (বৎসর)

১৮.১

১৬.৩

নীট গমন হার (প্রাথমিক)

৮৪.৪

৯৭.৭

ঝরে পড়ার হার (প্রাথমিক)

৩৯.৩

২০.৪

সাইকেল পূর্ণতার হার (প্রাথমিক)

৬০.৭

৮০.৪

সূত্র: বাংলাদেশ সরকার; এডুকেশন ওয়াচ; বাংলাদেশ ডেমোগ্রাফিক ও হেলথ সার্ভে

শিক্ষাক্ষেত্রে সিলেটের বর্তমান অবস্থান

শিক্ষাক্ষেত্রে বিভিন্ন সূচকের মধ্যে প্রায় প্রতিটি ক্ষেত্রেই সিলেট পিছিয়ে আছে। প্রাথমিক ও মাধ্যমিক ক্ষেত্রে স্কুলে নীট গমন হার (Net enrolment rate), ঝরে পড়ার হার, সাইকেল পূর্ণতার হার (completion rate) একটি শিক্ষা ব্যবস্থার নির্ণায়ক হিসেবে গণ্য করা হয়। দুঃখজঙ্কভাবে প্রায় প্রতিটি ক্ষেত্রেই সিলেট বাংলাদেশের অন্যান্য এলাকা থেকে পিছিয়ে আছে। সিলেটের প্রাথমিক স্কুলে নীট গমন হার দেশের গড় হারের চেয়ে প্রায় ১৫ শতাংশ (percentage point) কম। তবে ছেলেদের চেয়ে মেয়েদের নীট গমন হার একটু বেশি। মাধ্যমিক ক্ষেত্রে স্কুলে নীট গমন হার দেশের গড়ের প্রায় সমান সমান। ঝরেপড়ার হার এবং সাইকেল পূর্ণতার হারএর দিক থেকে সিলেট পিছিয়ে আছে। স্বাক্ষরতার হার একটি জনগোষ্ঠীর শিক্ষার সার্বিক অবস্থা নির্দেশ করে। সেখানেও আমরা সিলেটকে পেছনে দেখতে পাই।

অভ্যন্তরীণ বৈষম্যের একটি খতিয়ান

সিলেটের অভ্যন্তরেও শিক্ষাক্ষেত্রে বৈষম্য বিরাজমান। সিলেটের চারটি জেলার মধ্যে সুনামগঞ্জ সবার চেয়ে পিছিয়ে আছে। ঝরেপড়ার হার সুনামগঞ্জে সর্বাধিক। পরিবেশগতভাবে সিলেট বিভিন্ন ইকোসিস্টেমের সমষ্টি। এখনে যেমন আছে সমতলভূমি তেমনি আছে পাহাড়-টিলা ও হাওর। উন্নয়নসূচকে এই বিভিন্নতার প্রতিফলন চোখে পড়ে। শিক্ষার সবগুলো সূচকেই পাহাড়-টিলার সমষ্টি চাবাগান এবং হাওর এলাকা সমতলভূমির চেয়ে পিছিয়ে আছে। প্রশ্ন হল, কেন এই বৈষম্য বা অসম উন্নয়ন? এর জন্য শুধু কি ইকোসিস্টেমকে দায়ী করা যাবে? সম্ভবত না। এডুকেশন ওয়াচ নামক এক নাগরিক প্ল্যাটফরমের একটি রিপোর্ট থেকে জানা যায়, সিলেটে শিক্ষা বিষয়ক প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা দেশের অন্যান্য এলাকার তুলনায় অত্যোল্প। সিলেটের জনসংখ্যা যেখানে বাংলাদেশের মাত্র ৬.৪ভাগ,(মেডিকেল কলেজ ব্যতীত) সব ধরনের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা আনুপাতিক হারে সিলেটে কম। সিলেটের ভেতরে শিক্ষা সূচকে যে অসমতা বা বৈষম্য বিরাজ করছে তার প্রতিফলন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের সংখ্যার ক্ষেত্রেও দেখা যায়। প্রাথমিক স্কুলের সংখ্যার (জনসংখ্যার সাথে সামঞ্জস্য রেখে) বিচারে সর্বাগ্রে সিলেট জেলা। তারপরে রয়েছে সুনামগঞ্জ, মৌলভীবাজার ও হবিগঞ্জ। মাধ্যমিক স্কুলের ক্ষেত্রেও একই চিত্র বিদ্যমান। বিভিন্ন সুযোগ সুবিধা যেমন স্কুলে বিদ্যুৎ, খাবার পানি এবং মেয়েদের শৌচাগার – এর প্রতিটি ক্ষেত্রে সুনামগঞ্জ পিছিয়ে।

উন্নতির লক্ষণ?

সিলেটের বর্তমান শিক্ষা ব্যবস্থার যে চিত্র উপরে দেয়া হল তার কি কোন উন্নতি ঘটছে? হ্যাঁ, কিছু ক্ষেত্রে ঘটছে। এডুকেশন ওয়াচ থেকে পাওয়া তথ্য থেকে এ ব্যাপারে কিছু আলোকপাত করা যায়। ২০০২ সাল থেকে ২০১৬ সাল পর্যন্ত একটি স্ট্যান্ডারডাইজড পরীক্ষার মাধ্যমে মাধ্যমে পাওয়া স্বাক্ষরতার হার-এ বেশ উন্নতি লক্ষ্য করা যাচ্ছে। এই সূচকে ১৪ বছরে বাংলাদেশের মধ্যে সর্বাধিক অগ্রগতি হয়েছে সিলেটে – ১৪.৪ শতাংশ (percentage point)

উপসংহার

সিলেটের পিছিয়ে পড়ায় পরিবেশ/ইকোলজিগত কারণ ছাড়াও বঞ্চনার ব্যাপারটিও আছে। এর ফলে বৈষম্য যে শুধু সিলেটের সাথে বাংলাদেশের অন্যান্য অংশের তৈরি হয়েছে তাই নয়, এমনকি সিলেটের অভ্যন্তরে বিভিন্ন জেলা এবং উপজেলার মধ্যেও দেখা যাচ্ছে। সিলেট জেলা অন্য তিনটি জেলা থেকে বেশিরভাগ ক্ষেত্রে এগিয়ে রয়েছে যার ঐতিহাসিক কারণ ছাড়াও রয়েছে ইদানীং শিক্ষাক্ষেত্রে এনজিও ও বেসরকারি উদ্যোগ। শেষোক্ত উদ্যোগের ফলে বেশী লাভবান হয়েছে সিলেট জেলা। সিলেট বিভাগের সেরা স্কুলগুলোর অবস্থান সিলেট নগরী বা তার আশপাশে। এর মধ্যে রয়েছে স্কলার্স হোম, আনন্দনিকেতন, ব্র্যাক, সীমান্তিক এবং এফআইভিডিবি। শিক্ষাসহ সিলেটের বিভিধ সমস্যা সমাধানে সিলেটবাসীদেরই সোচ্চার হতে হবে।

লেখক যুক্তরাষ্ট্রের কলোম্বিয়া ইউনিভার্সিটির অধ্যাপক এবং ব্র্যাকের সাবেক ভাইসচেয়ার।