দেশের আর্থিক চাপ সামাল দিতে সরকারের সঙ্গে বাংলাদেশ ব্যাংকও একের পর এক উদ্যোগ নিচ্ছে। ডলার নিয়ে কারসাজির অভিযোগে বেশ কয়েকটি মানি চেঞ্জারের লাইসেন্স বাতিলের পর সর্বশেষ দুর্বল ১০টি ব্যাংক চিহ্নিত করেছে কেন্দ্রীয় ব্যাংকটি।

এ ছাড়া এর আগে আগামী বছরের জুন পর্যন্ত দেশের সব ব্যাংকের গাড়ি কেনা বন্ধ করার পাশাপাশি অ্যাপায়ন, ভ্রমণ, আসবাব ও বৈদ্যুতিক সরঞ্জাম কেনার খরচও অর্ধেক করে দেওয়া, ব্যাংকঋণ পুনঃতফসিল ও পুনর্গঠনের নীতিমালা সংশোধন এবং আমদানি ঋণপত্র খোলার সংখ্যা কমানোসহ আরো বেশ কিছু পদক্ষেপ নেওয়া হয়। এসব পদক্ষেপকে ইতিবাচক হিসেবে দেখছেন অর্থনীতিবিদরা। তারা বলছেন, দেশের আর্থিক সংকটে সরকারের পাশাপাশি কেন্দ্রীয় ব্যাংকও যেসব উদ্যোগ নিয়েছে বা নিচ্ছে তা ইতিবাচক ভূমিকা পালন করছে। এসব উদ্যোগের ফলে আশা করা যায় খুব দ্রুতই দেশের এ আর্থিক সংকট কেটে যাবে।


এসব বিষয় নিয়ে পলিসি রিসার্স ইনস্টিটিউটের নির্বাহী পরিচালক ও আইএমএফের সাবেক অর্থনীতিবিদ আহসান এইচ মনসুরের সঙ্গে কথা হলে তিনি ঢাকা টাইমসকে বলেন, ‘দেশের আর্থিক অবস্থা এখন অনেক অস্থিরতার মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। তাই সঠিক সময়ে সঠিক সিদ্ধান্ত না নেওয়া হলে আরো বড় ক্ষতির মুখে পড়তে পারি। এমন অবস্থায় আইএমএফের ঋণ প্যাকেজ অনুমোদন দিলে বাজার স্থিতিশীল হবে এবং আমরা কিছু তহবিল পাব, যা দিয়ে রিজার্ভ উন্নত করা যাবে।’

 

ডলার কারসাজি ঠেকাতে উদ্যোগ

ডলার নিয়ে কারসাজি করায় পাঁচ মানি চেঞ্জারের লাইসেন্স স্থগিত করেছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। পাশাপাশি ৪২টিকে কারণ দর্শাতে বলা হয়েছে।

শোকজের যথাযথ উত্তর দিতে পারলে এসব মানি এক্সচেঞ্জের লাইসেন্সের বিষয়ে বিবেচনা করা হবে। অভিযানে আরও নয়টি প্রতিষ্ঠানকে সিলগালা করা হয়েছে। এসব প্রতিষ্ঠান লাইসেন্স না নিয়ে এতদিন ব্যবসা করে আসছিল।

 

দুর্বল ১০ ব্যাংক চিহ্নিত করা

বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর আব্দুর রউফ তালুকদার বলেছেন, ‘আমানতকারীদের অর্থ নিরাপদ রাখতে কাজ করছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। এ কারণে কয়েকটি ইন্ডিকেটর বিবেচনা করে দুর্বল ১০টি ব্যাংক চিহ্নিত করা হয়েছে।’

গভর্নর বলেন, ‘একটি ব্যাংক দুর্বল হলে অন্য ব্যাংকের ওপর এর প্রভাব পড়ে। তাই, আমানতকারীদের কথা চিন্তা করে তাদের অর্থ যেন নিরাপদ থাকে সেজন্য ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। তাদের সাপোর্ট দেওয়া হবে। আমাদের উদ্দেশ্য কোনো ব্যাংক বন্ধ বা দুর্বল করা নয়, সব ব্যাংককে সবল করা। এজন্য চারটি ইন্ডিকেটর (শ্রেণিকৃত ঋণের মাত্রা, মূলধনের পর্যাপ্ততা, ঋণ-আমানত অনুপাত ও প্রভিশনিং) বিবেচনা করে ১০টি ব্যাংকের তালিকা করেছি। এই ব্যাংকগুলো আবার সবল হোক, ব্যবসায় ফিরে আসুক, ডিভিডেন্ড দিক, এসব আমরা চাই।’

 

সব ব্যাংকের গাড়ি কেনা বন্ধ এবং অ্যাপায়ন, ভ্রমণ অর্ধেক

বৈশ্বিক অর্থনৈতিক প্রেক্ষাপটে সরকার চলতি ২০২২–২৩ অর্থবছরের বিভিন্ন খাতে পরিচালন ও উন্নয়ন ব্যয় স্থগিত বা হ্রাসের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। এরই অংশ হিসেবে ব্যাংকের কিছু পরিচালন ও উন্নয়ন ব্যয় স্থগিত বা হ্রাসের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। নির্দেশনা অনুযায়ী, চলতি বছরের ছয় মাস (জুলাই থেকে ডিসেম্বর) ও আগামী বছরের প্রথম ছয় মাস (জানুয়ারি থেকে জুন) ব্যাংকের নতুন ও প্রতিস্থাপক হিসেবে সব ধরনের গাড়ি কেনা বন্ধ থাকবে।

এ ছাড়া জরুরি ও অপরিহার্য ক্ষেত্র বিবেচনায় আপ্যায়ন, ভ্রমণ, কম্পিউটার ও আনুষঙ্গিক, বৈদ্যুতিক সরঞ্জাম, আসবাব ও অন্যান্য মনিহারি খাতে বরাদ্দ করা অর্থের সর্বোচ্চ ৫০ শতাংশ ব্যয় করতে পারবে ব্যাংকগুলো।

বাংলাদেশ ব্যাংক বলেছে, গাড়ি কেনা বন্ধ এবং আপ্যায়ন, ভ্রমণ, কম্পিউটার ও আনুষঙ্গিক, বৈদ্যুতিক সরঞ্জাম, আসবাবসহ মনিহারি পণ্য কেনাকাটায় খরচ অর্ধেক কমানোর ফলে যে অর্থ সাশ্রয় হবে, তা অন্য কোনো খাতে খরচ না করার কথা বলা হয়।

 

ব্যাংকঋণ পুনঃতফসিল ও পুনর্গঠনের নীতিমালা সংশোধন

নানা সমালোচনার মুখে ব্যাংকঋণ পুনঃতফসিল ও পুনর্গঠনের নীতিমালা সংশোধন করে বাংলাদেশ ব্যাংক। ব্যাংকের খেলাপি হওয়া কোনো ঋণ সর্বোচ্চ তিনবার পুনঃতফসিল করা যাবে। এর বাইরে প্রাকৃতিক কারণে কোনো ঋণ খেলাপি হলে বিশেষ বিবেচনায় আরও একবার তা পুনঃতফসিল করা যাবে। আর পুনঃতফসিলের আওতায় থাকা ঋণ নগদে আদায় হলেই কেবল তা যুক্ত হবে ব্যাংকের আয়ে। আবার ঋণ পুনঃতফসিলের পর ছয় মাস কিস্তি পরিশোধ না করলে সেই ঋণ সরাসরি খেলাপি হয়ে যাবে।

তবে আগের মতো এককালীন জমা ও ঋণের মেয়াদ বহাল রাখা হয়েছে। গত ১৮ জুলাই খেলাপি ঋণ পুনঃতফসিল সংক্রান্ত নীতিমালা জারি করে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। সেখানে ঋণখেলাপিদের বড় ধরনের ছাড় দেওয়া হয়। খেলাপি ঋণ পুনঃতফসিলের ক্ষমতা বাংলাদেশ ব্যাংকের বদলে সংশ্লিষ্ট ব্যাংকের হাতে ন্যস্ত করা হয়েছিল। গত ১২ জুলাই নতুন গভর্নর হিসেবে সাবেক অর্থসচিব আব্দুর রউফ তালুকদার যোগ দেওয়ার পরপরই এ নীতিমালা জারি করা হয়।

 

আমদানি ঋণপত্র খোলার সংখ্যা কমানো

গত জুলাই মাসে দেশে পণ্য আমদানির জন্য ঋণপত্র খোলা হয়েছে ৫৪৭ কোটি ৮৫ হাজার ৬৭ ডলারের। তার আগে জুন মাসে ঋণপত্র খোলার পরিমাণ ছিল ৭৯৬ কোটি ৪৫ লাখ ৩৮ হাজার ১০৫ ডলারের। সেই হিসাবে এলসি খোলায় এক মাসে আমদানি ব্যয় সাশ্রয়ের পরিমাণ ২৪৯ কোটি ৪৪ লাখ ৫৩ হাজার ৩৭ ডলার বা ২৩ হাজার ৬২২ কোটি টাকা। এ হিসাবে গত এক মাসে ব্যয় সাশ্রয় হয়েছে ৩১ দশমিক ৩২ শতাংশ।

ব্যয় সাশ্রয়ে সম্প্রতি সরকার ও কেন্দ্রীয় ব্যাংকের গৃহীত পদক্ষেপের সুফল হিসেবে অপ্রয়োজনীয় আমদানি ব্যয় কমেছে বলে বাংলাদেশ ব্যাংকের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে।

এসব বিষয়ে আলাপ হলে বাংলাদেশ অর্থনীতি সমিতির সাধারণ সম্পাদক অধ্যাপক আইনুল ইসলাম ঢাকা টাইমসকে বলেন, ‘বাংলাদেশ ব্যাংক ডলার নিয়ন্ত্রণে রাখতে একের পর এক উদ্যোগ নিয়ে যাচ্ছে। ডলার রিজার্ভের বর্তমান পরিস্থিতি বিবেচনায় আমানত হিসাবে কেউ ডলার জমা রাখালেই তাকে চার থেকে পাঁচ শতাংশ পর্যন্ত সুদ দেওয়ার কথা বলা হয়েছে, যা একটি ইতিবাচক সিদ্ধান্ত। ডলার সংকট মোকাবেলায় এছাড়া সময়ে সময়ে বাংলাদেশ যেসব সিদ্ধান্ত নিয়েছে সবগুলোই ছিল সময়োপযোগী।’

সিলেটভিউ২৪ডটকম/ঢাটা/ইআ