ছোট চাচ্চু মাথা নিচু করে খাটের কোণায় বসে আছেন। তার দু'চোখে নোনাজল ছলছল করছে। বাবা একটু পরপর তার রুম থেকে বের হয়ে আঠারো বছরের চাচ্চুকে উত্তম-মধ্যম দিচ্ছেন। বাসায় থমথমে অবস্থা। ভয়ে আমার পা কাঁপছে। এই ছোট্ট জীবনে বাবার মেজাজ সম্পর্কে আমি যেটুকু অভিজ্ঞতা অর্জন করেছি তা হলো, চাচ্চুর পিঠে লাল লাল দাগ না-পড়া পর্যন্ত তার নিস্তার নেই। রেহাই নেই।
 

মা রাগান্বিত বাবার পাশে গিয়ে দাঁড়ালেন। ফিসফিস করে বললেন-'তোমার মাথাটা একটু ঠান্ডা করো তো। এভাবে রাগ দেখিয়ে কোনো লাভ নেই। তারচেয়ে বরং মাথা খাটিয়ে একটা সমাধান বের করো।'
 


আমাদের পাশের বাসার কাজের মেয়ে ফুলি তার মাকে নিয়ে অশ্রুস্নাত চোখে গুটিসুটি হয়ে ফ্লোরে বসে আছে। দৃষ্টিতে তার অসহায়ত্বের ছাপ স্পষ্টত দৃশ্যমান।

'কীসের সমাধান ? আমি কিচ্ছু জানি না। আমার মান-সম্মান সব সাগরের তলানিতে গিয়ে মিশেছে। ওরে আমি বাড়ি থেকে বের করে দিবো। কত্ত বড় বজ্জাত। আজ বাবা বেঁচে থাকলে তাকে টুকরোটুকরো করে শিয়াল কুকুরকে খাওয়াতেন। ফাজিল কোথাকার! '
 

চিৎকার করে বললেন বাবা। তার দু'চোখ দিয়ে যেন ড্রাগনের মতো আগুন বেরুচ্ছে। আমি সে আগুনের শিখায় দগ্ধ হচ্ছি।

ফুলির মায়ের সাথে শুরু হল কপাটবদ্ধ বৈঠক। তাতে যোগ দিলেন গোষ্ঠীর হর্তাকর্তারা। এমনকি যাদেরকে জীবনে কখনো আমাদের বাসায় পা পড়তে দেখিনি, তারাও। সিদ্ধান্ত হলো রাত পোহালেই এবরশন!
 

সবাই হাফ ছেড়ে বাঁচলেন। উফ্.. এবারের মতো রক্ষা তাহলে। রাখে আল্লাহ, মারে কে!

চাচ্চু আমাকে কাছে টানলেন। বললেন- কী রে, তুই কিছু বুঝচ্ছিস? 
-না চাচ্চু, আমি কিছু বুঝিনি।
-ঠিক আছে বাবা, ছোটদের এতকিছু বুঝতে নেই।

ঠিক পরের দিন। সন্ধ্যায় গুড়িগুড়ি বৃষ্টি হচ্ছে। বাসার সামনে একটা গাড়ি এসে থামলো। সবার দৃষ্টি ঐ গাড়ির দিকে। গাড়ি থেকে চাচ্চু নামলেন। গায়ে লাল টুকটুকে পাঞ্জাবী। ঘুরে গিয়ে ঐ পাশের দরজাটা খুলতেই বেরিয়ে এলো গোলাপী এক পরী। আবছা আলোতে অস্পষ্ট মুখমন্ডল।
 

নিকটে আসতেই চেহারা স্পষ্ট হলো। মা চিৎকার দিয়ে বললেন- 'আরে, এ তো দেখি ফুলি। কাজের মেয়ে ফুলি! এত বড় সাহস, সে ফুলিকেই বিয়ে করল!'

আজ। আঠারো বছর পর...

চাচ্চুর বড় মেয়ে অনিশা খাটের কোণায় বসে অঝরে কাঁদছে। চাচ্চুও কাঁদছেন তার রুমে বসে। তাকে শান্তনা দেওয়ার মতো কেউ নেই। আমি তার কাঁধে হাত রেখে বললাম, টেনশন করো না চাচ্চু, সব ঠিক হয়ে যাবে। আমাকে জড়িয়ে ধরে তিনি বাচ্চাদের মতো হাউমাউ করে কেঁদে বললেন, 'বাবারে, আমার এই প্রতিবন্ধী মেয়েটার এমন সর্বনাশ কে করল'।
 

আমার এই মুহূর্তে মনেহচ্ছে তিনিই পৃথিবীর একমাত্র অসহায় পিতা !