অতীতের কাছে আমরা ঋণী চিরকাল। মাঝে মাঝে স্মরণ করে এ ঋণ শোধ করা যাবে না, তবে; আমাদের কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করা উচিত উন্নয়নের প্রথম এবং পর্যায়ক্রমিক সময়ের যুগের মানুষকে। আজকের একবিংশ শতাব্দীর এই উন্নত মস্তিষ্কের মানুষ আদিম যুগের বর্বর মানুষ থেকে ধীরে ধীরে উন্নত অবস্থায় এসেছে। এখন মানুষ বিজ্ঞান ও বৈজ্ঞানিক আবিষ্কারের মহা ধুমধাম যুগে বসবাস করছে। একসময়ের কৃষিজীবী মানুষের কৃষিপ্রধান বাংলাদেশের মানুষ আর শুধুই কৃষক নয়, বরং সরকারের বহুমুখী উন্নয়ন কার্যক্রমে এখন বাংলাদেশ শিক্ষা জ্ঞান বিজ্ঞান ও আধুনিক প্রযুক্তিতে বিশ্বের মানুষের নজর কেড়েছে। বিগত বছরগুলোতে বাংলাদেশের যোগাযোগ ক্ষেত্রে অভাবনীয় উন্নতি হয়েছে তা স্বীকার করতে হবে। 

 


আজকের এই অবস্থায় দাঁড়িয়ে আমি কয়েক হাজার বছর পিছনে মানব সভ্যতার ইতিহাস খোঁজে দেখি, আমরা সেই আদিম যুগের মানুষ থেকে অনেক কষ্টে এই সভ্যতায় এসেছি। সভ্যতার এ সময়ে এসে আমরা বিশ্বের জাতিসংঘ গড়ে তুললেও দেশে দেশে জাতিতে জাতিতে চলছে যুদ্ধ, তখন কিন্তু সারা পৃথিবীর এরকম জাতিসংঘ ছিলো না। যুদ্ধ তখনও ছিলো। তবে তখন যুদ্ধে এখনকার মতো এতো তীক্ষ্ণ যুদ্ধাস্ত্র আবিষ্কার হয়নি। মানুষ ধীরে ধীরে জ্ঞান বিজ্ঞান ও বর্ণমালায় এ পর্যায়ে পৌঁছে। জানা দরকার হাজার হাজার বছরের নানান যুগ নানান সভ্যতার উত্থান পতনের ইতিহাস। এ কাজে আমাদের প্রিয় সংবাদ মাধ্যম সবচেয়ে ভালো ভূমিকা রাখতে পারে। 

এখানে 'প্রাগৈতিহাসিক' বলে একটা শব্দ আছে, সহজেই বুঝতে পারা যায়, পৃথিবীর মানুষের আবির্ভাবের ইতিহাস সম্পূর্ণ জানা যায়নি। তবে যেটুকু জানা গেছে সে সম্পর্কে আমাদের ধারণা রাখতে হবে। বরফ যুগের পরে আদিম মানুষরা নতুন পাথরের যুগে প্রবেশ করে। তখন পাথরের অস্ত্র বা হাতিয়ার তৈরী করে মানুষ পশু শিকার করতো। সে যুগের ওই পাথরের হাতিয়ার ছিলো পূর্বের ইতিহাস জানা সময়ের তুলনায় মসৃণ ও উন্নত। এ যুগকে নাম দেয়া হয় নতুন পাথরের যুগ। আদিম যুগের শিকারী মানুষকে যেমন বন্য পরিচয় দেয়া হতো, তেমনি কৃষিজীবী মানুষকে বর্বর জাতি বলা হয়েছে। কৃষিজীবীদের গ্রাম সমাজের সৃষ্টি প্রথম হয়েছিলো পশ্চিম এশিয়ায়। নতুন পাথরের যুগে কৃষিজীবী মানুষ অনেক নতুন যন্ত্রপাতি ও কৃষি কৌশল আবিষ্কার করেছিলো। পাথরের কোদাল, কুড়াল, মাটির বাসন, তুলা বা শনের আঁশ থেকে সুতা তৈরি, বাঁশ, বেতের ঝুড়ি, গম ভাঙার যন্ত্র, রুটি সেঁকার কৌশল, নল খাগড়ার বেড়া কাদায় লেপে ঘর বানানো, লাঙ্গল, কাঠের নৌকা, মাটির গর্তে পাতা দিয়ে শস্য সংরক্ষণ, এমনকি সূর্য ও চন্দ্র দেখে দিন মাস বছর গুনতেও শিখে তারা। ওইসময় মানুষ পশু পালন করতে শিখেছিলো। নতুন পাথরের যুগে মানুষ বৃদ্ধি পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে কৃষি সমাজ পৃথিবীর বিভিন্ন অঞ্চলে ছড়িয়ে যায়। আজ থেকে প্রায় সাত হাজার বছর আগে এশিয়ার পশ্চিম এলাকায় ইরাক অঞ্চলে মানুষ প্রথম নগর সভ্যতা গড়ে। এ যুগেই মানুষ চিন্তায় উন্নত হয়। মানুষ তামা ও ব্রোঞ্জ ধাতু পেয়ে যায় এবং এসবের হাতিয়ার তৈরী শুরু করে। তাই পুরান পাথরের পরের এ যুগকে ব্রোঞ্জ যুগ নাম দেয়া হয়। এরপর মানুষ সভ্যতার ধারাবাহিক গতিতে এগুতে থাকে। ক্রমশ মিশর, হরপ্পায় মহেঞ্জোদারো, চীন ইত্যাদি স্থানে ব্রোঞ্জ যুগ প্রসারিত হয়ে নগর সভ্যতা গড়ে উঠে। প্রাচীন ইরাকে যে নগর সভ্যতা গড়ে তুলেছিলো মানুষ, সেটি তখন মেসোপোটেমিয়া নামে পরিচিত ছিলো। অতীতের সুমেরীয়, ব্যবিলনীয়, আসিরিয় ও ক্যালডীয় সভ্যতাকে একসাথে মেসোপোটেমিয়া সভ্যতা বলা হয়।

মেসোপোটেমিয়া শব্দ দ্বারা বুঝানো হয়েছে, 'দুই নদীর মধ্যবর্তী দেশ'। ইরাক যেহেতু টাইগ্রিস ও ইউফ্রেটিস এই দুই নদীর মধ্যের এক অঞ্চল, সেজন্যে ওই অঞ্চলের এমন নামকরণ হয়। ধারণা করা হয় চারদিকে ঢাকা চুলায় মাটির হাঁড়ি পাতিল পুড়িয়ে শক্ত করতে গিয়ে মানুষ প্রথম তামা আবিষ্কার করে। তামার আকর মিশে থাকতো মাটিতে। আকর পুড়লে তামা গলে আলাদা হয়ে বেরিয়ে আসে। ওই তামা আবিষ্কারের পথ ধরেই সে যুগের মানুষ ব্রোঞ্জ নামক মিশ্রধাতু আবিষ্কার করে। ব্রোঞ্জ হলো তামা ও টিনের মিশ্রধাতু। পশ্চিম এশিয়ায় মাটির উপরেই ওই মিশ্রধাতুর আকর পাওয়া যেতো। পরবর্তী পর্যায়ে মানুষ জ্ঞান খাটিয়ে তামা ও টিনের অনুপাত ঠিক ঠিক মিশিয়ে ব্রোঞ্জ তৈরী করে ফেলে। এখান থেকেই ব্রোঞ্জ তৈরীর কৌশল পর্যায়ক্রমে মিশর ও চীন এবং অন্যান্য অঞ্চলে বিস্তার লাভ করে। আমরা পরবর্তীতে পাই হিট্টাইট সভ্যতা। পশ্চিম এশিয়ায় ২০০০ থেকে ১২০০ খৃষ্ট পূর্বাব্দের মধ্যে হিট্টাইটরা রাজত্ব করে। হিট্টাইটরা লোহার আবিষ্কার করে মানব সভ্যতাকে দ্রুত এগিয়ে যাওয়ার পথ দেখায়। লোহার হাতিয়ার ও বহু প্রয়োজনীয় যন্ত্র আবিষ্কারের ফলেই পরবর্তীকালে গ্রীকরা উন্নত সভ্যতা নির্মাণ করতে পেরেছিলো। অনেক পরে খ্রীস্টপূর্ব অষ্টম শতাব্দীতে তুরস্কের পশ্চিম এলাকায় লিডিয়া রাজ্যের আবির্ভাব ঘটে। তখন এশিয়ার মধ্যভাগ ও ভূমধ্যসাগরীয় অঞ্চলের মধ্যে ব্যবসা বানিজ্য চলতো লিডিয়া রাজ্যের মধ্য দিয়ে। জানা যায় তৎকালীন লিডিয়াই ওই অঞ্চলে সর্বপ্রথম ধাতব মুদ্রা বা টাকার প্রবর্তন করে। তখন নির্দিষ্ট ওজনের স্বর্ণ বা রৌপ্য মুদ্রায় রাজার ছবি থাকতো। সেখান থেকেই ক্রমে সকল অঞ্চলে দেশে দেশে বাণিজ্যিক লেনদেনে মুদ্রার প্রচলন শুরু হয়। আমরা এখন পাই বাংলাদেশের টাকায় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ছবি, ভারতের রূপিতে আছে মহাত্মা গান্ধীর ছবি। 

নতুন পাথরের যুগের কৃষিজীবী সমাজ অনেক পরে ইউরোপে প্রবেশ করে। কারণ সেখানকার মাটি ছিলো পাথুরে এবং শক্ত গাছের বন কাটা কঠিন ছিলো। যখন ব্যবিলন, মিশর প্রভৃতি স্থানে ব্রোঞ্জের প্রচলন হয় এবং তারও পরে যখন হিট্টাইটরা লোহার আবিষ্কার করে ফেলে, তখন এশিয়ার কৃষিজীবী মানুষ কুড়াল ইত্যাদি ধাতুর হাতিয়ার নিয়ে ইউরোপ গমন করে চাষাবাদ পশুপালন শুরু করে। বর্তমান সিরিয়া ও লেবাননের পশ্চিম উপকূলজোরে ছিলো প্রাচীন ফিনিশীয় সভ্যতা। তারা জাহাজ নির্মাণ করতো। নিজের তৈরী জিনিস তারা নিজেরা জলপথে নিয়ে বিক্রি করতো। তারা বিভিন্ন স্থানে গিয়ে উপনিবেশ বা নগর গড়ে তুলতো। এই ফিনিশীয়দের বড়ো কীর্তি হচ্ছে বর্ণমালা সৃষ্টি। মিশরের চিত্রলিপি থেকে ২২টি চিনহো বা প্রতীক নিয়ে তারা বর্ণমালা সৃষ্টি করে। আজকে বাংলারও সমৃদ্ধ বর্ণমালা আছে। যদি মানুষ পড়া ও লেখার কৌশল আবিষ্কার করতে না-পারতো, তাহলে ধারাবাহিক ভাবে আমাদের পক্ষে এখনও পর্যন্ত পৃথিবীর ইতিহাস ও ঐতিহ্য জানা ও নতুনদেরকে তা জানানো দুরূহ ব্যাপার হতো। যারা বিভিন্ন রকমের বা আকৃতির চিহ্ন বা বর্ণ দ্বারা লেখার রীতি আবিষ্কার করে গেছেন এবং পরে ধারাবাহিক ভাবে সেই কঠিন কাজটিকে আরও সহজ করে রেখে গেছেন, তা কৃতজ্ঞতার সাথে স্মরণ করতে হবে। 

পরবর্তী সময়ের গ্রীকদের কথা বলতে হয়, গ্রীকরা একটা বড়ো দেশে সবাই বাস করতো না। তারা ৮০০ থেকে ৬০০ খ্রীষ্ট পূর্বাব্দে ভূমধ্যসাগরের বিভিন্ন এলাকায় ছোটো ছোটো নগর রাষ্ট্র গড়ে তোলে বসবাস করতো। পরে তারাও ফিনিশীয়দের থেকে নৌবিদ্যা, ব্যবসা, কারিগরি শিল্প ইত্যাদি জ্ঞান আয়ত্ত করে এবং তারা তখন রাজনৈতিক ভাবে গণতন্ত্র চর্চা করতো। গ্রীক নগর সমূহে মানুষের মতামতের ভিত্তিতে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হয়েছিলো। গণতন্ত্রের জন্যে এখনও দেশে দেশে আন্দোলন চলছে। প্রাচীন গ্রীসে বিজ্ঞানের অগ্রগতি হয়েছিলো। দুর্ভাগ্য হলো, গ্রীসের সেই নগর রাষ্ট্রগুলো দুটো বড়ো বড়ো যুদ্ধের ফলে দুর্বল হয়ে যায়। ৪৮০ খ্রীষ্ট পূর্বাব্দে পারস্য সম্রাট গ্রীসের মূল ভূখণ্ড পর্যন্ত অগ্রসর হয়ে এথেন্সকে ধ্বংস করে দেন। তারপর অবশ্য ৪৭৯ খ্রীস্ট পূর্বাব্দে পারসীকরা গ্রীকদের সম্মিলিত বাহিনীর হাতে পরাজয় বরণ করে। তারপরও গ্রীক - পারসীক যুদ্ধ আরও ত্রিশ বছর ধরে চলেছিলো। এরপর আবারও ৪৩১ থেকে ৪০৪ খ্রীষ্ট পূর্বাব্দ পর্যন্ত এথেন্স ও স্পার্টার মধ্যে দীর্ঘস্থায়ী যুদ্ধ চলে। ওই যুদ্ধের ইতিহাস এখন জ্ঞান বিজ্ঞান ও ইতিহাস সচেতন কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ুয়া প্রায় সকলেরই জানা। ইতিহাসে এটা পেলোপনেসীয় যুদ্ধ নামে পরিচিত। এরপর পাই আলেকজান্ডার মৃত্যুর পরে তার বিশাল সাম্রাজ্য তিন খন্ডে বিভক্ত হয়ে যায়। এভাবেই চলে এবং ধারাবাহিকতায় পাওয়া যায় রোমের ইতিহাস, বাইজেন্টাইন সাম্রাজ্য।

পৃথিবীর ইতিহাস দীর্ঘ। সংক্ষিপ্ত একটি প্রবন্ধে সব বিষয় তুলে ধরা যায় না। পরবর্তী সময়ে ১৪৫৩ খ্রীস্টাব্দে অটোমান তুর্কীদের আক্রমণে বাইজেন্টাইন সাম্রাজ্যও অবলুপ্ত হয়। এরপর এগিয়ে যাওয়া যায় চীনের ইতিহাস এবং ভারতীয় উপমহাদেশে মানব সভ্যতার অগ্রগতির ইতিহাসের দিকে। এসব বিষয় আমরা কমবেশি জানি। আজকে আমরা সভ্যতার একটা বিশেষ পর্যায়ে এসেছি। এভাবেই আদিম মানুষ ধীরে ধীরে সভ্যতা রচনা করে এগিয়েছে এবং এখন অতি আধুনিক বিজ্ঞান চর্চার মাধ্যমে বর্তমান সভ্য মানুষ আরও এগিয়ে যাচ্ছে। 

পৃথিবীতে মানব সভ্যতার ইতিহাস দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর। সেই আদিম যুগের কষ্টময় যোগাযোগ ব্যবস্থা থেকে আজকের বঙ্গোপসাগরের তীরে এই বাংলাদেশের মানুষ দেখতে পাই মেট্রোরেল, এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে, কর্ণফুলী টানেল, আধুনিক বিমান বন্দর, জেলায় জেলায় মেডিক্যাল কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয় এবং এক জেলা থেকে আরেক জেলায় যোগাযোগের সুপ্রশস্থ রাস্তা। উন্নয়নের এ ধারা অব্যাহত থাকলে আমরা একসময় সিঙ্গাপুর, মালয়েশিয়া ইত্যাদি দেশের সুযোগ উপভোগ করতে পারবো। আমরা যতো জানতে চেষ্টা করবো ততোই বুঝতে পারবো কিভাবে আজকের এই সুন্দর মানব বসতি এবং এতো এতো উন্নত সুযোগ সুবিধা আমরা পেয়েছি। আজকের এই উন্নতি অনেক কষ্টে এসেছে। আমাদের চেষ্টা থাকা উচিত আমরা যেনো যুদ্ধে যুদ্ধে এমন একটি উন্নত মানব বসতিকে অবহেলায় ধ্বংস না-করি। আমাদের ইতিহাস জানা হোক, আমাদের বোধোদয় হোক।

 

লেখক: মোহাম্মদ আব্দুল হক কলামিস্ট ও প্রাবন্ধিক