বাংলা নববর্ষ বাঙালিদের সংস্কৃতির সবচেয়ে বড় সামাজিক উৎসব। ষড় ঋতু আবর্তিত হয়ে শেষ হয় বাংলা বছর। ঋতুরাজ বসন্ত উত্তির্ণ হয়ে আগমন ঘটে গ্রীষ্মের, ঘোষিত হয় নুতন বছর। চৌদ্দ শ’ আটাশ এর বিদায়লগ্নে সমাগত ১৪২৯ বঙ্গাব্দ। গ্রীষ্ম এসে নিজের মত করে সাজিয়ে নেবে প্রকৃতিকে। বছর গড়িয়ে যাবার সাথে সাথে প্রকৃতিও পুরনো হতে থাকে, জীর্ণতা এসে ক্রমে ক্রমে ভিড় করে প্রকৃতি ও মানুষের মনে-মননে। বসন্তের শেষ লগ্নে প্রকৃতি রৌদ্রস্নাত আবহে খরতাপের যে পরিবেশ তৈরি করে দেয়, সেটাও আবহমান বাংলার ষড়ঋতুর এক বিচিত্র রূপ। যুগ যুগ ধরে বাংলার ঋতুবৈচিত্র্যকে ঘিরেই আমাদের সংস্কৃতিচেতনা স্বকীয়তা  অর্জন করেছে। নতুন বছরের সূচনারূপে বাংলার মানুষ সাড়ম্বরে উৎযাপন করে পহেলা বৈশাখের বর্ষবরণ উৎসব।

আমরা মনে প্রাণে বাঙালি হলেও, কিছু কিছু ক্ষেত্রে সমাজে ক্রমে ক্রমে সাংস্কিৃতিক বিচ্যুতি ঘটে চলেছে। অপসংস্কৃতির আগ্রাসনে ক্রমশ দুর্বল হয়ে পরছে আমাদের নিজস্ব সংস্কৃতিক ঐতিহ্য। এর ফলে কিশোর অপরাধ বৃদ্ধি পাচ্ছে, যুবসমাজ সংস্কৃতির পরিবর্তে অপসংস্কৃতিকেই বেশী প্রাধান্য দিচ্ছে। তারা আজ দিশেহারা, পথভ্রষ্ট। শিক্ষাঙ্গনে সন্ত্রসের সাথে আজ যুক্ত হচ্ছে নুতন উপদ্রপ ‘র‌্যাগিং’। নিরীহ ও সাধরণ ছাত্র-ছাত্রীদের জন্য পড়াশুনার অনুকুল পরিবেশ নেই। সহিংসতার কারণে স্বাভাবিক পড়াশোনা দুরের কথা, ক্ষেত্রবিশেষে জীবন বিপন্ন হচ্ছে।


‘ইভটিজিং’ বর্তমান সমাজ জীবনের একটি দুষ্ট ক্ষত। এর হিংস্র  থাবায়  ক্ষতবিক্ষত হয়ে অপমানের দহনে বহু কিশোরি-তরুনী অত্মহননের নির্মম পথ বেছে নিচ্ছে। কারো কারো মতে, এই দেশের হাই স্কুলের ছাত্রীদের শতকরা ৮০ ভাগ মেয়ে ইভটিজিংয়ের শিকার হয়। যেসকল মেয়ে ঝরে পরে, তার ৭০ ভাগের বেশি মেয়ের লেখাপড়া বন্ধ হয়ে যায় এই ইভটিজিংয়ের কারনে। প্রতিবাদ করতে গিয়ে অভিবাবকরা পর্যন্ত নিগ্রহের শিকার হচ্ছেন অথবা প্রাণ হারাচ্ছেন। দুঃখজনকভাবে যৌন নিপিড়নের শিকার হচ্ছেন শিশু থেকে বৃদ্ধা পর্যন্ত। যারা এটি নিয়ে গবেষণা করেন তাদের মতে শতকরা ৭০ ভাগ ধর্ষন করে থকে পরিচিত মানুষ কিংবা আত্মীয়স্বজন। প্রায় প্রতিটি ক্ষেত্রেই মেয়েটিকে যৌন নির্যাতন করেছেন তাদের বৃহত্তর পরিবারের কোন সম্মানিত গুরুজন, কোন মামা, চাচা, খালু কিংবা ফুপা। ভয়ঙ্কর সহিংসতার শিকার দেশের নারীসমাজ। পথ চলতে, বাসে চড়তে তারা চরম নিরাপত্তাহীন। একজন সরলমনা বিজ্ঞানের শিক্ষক তাঁরই প্রিয় ছাত্রদের দ্বারা প্ররোচিত হয়ে অবশেষে সেই ছাত্রদের দ্বারাই প্রতারিত ও বিপদগ্রস্থ হচ্ছেন। সাধ করে কপালে একটি টিপ পরে রাস্তায় বেরিয়ে প্রকাশ্য দিবালোকে নিগ্রহের শিকার  হচ্ছেন একজন অধ্যাপিকা। এসবই একটি সভ্য সমাজের জন্য গ্লানি ও লজ্জার বিষয়। এ সকল সামাজিক সমস্যা সমাধানের জন্য শুধু আইনশৃঙ্খলা সংস্থার উপর নির্ভর না করে সামাজিক ও সাংস্কৃতিক আন্দোলনের মাধ্যমে এর প্রতিরোধে এগিয়ে আসা জরুরী। সমাজের রন্ধ্রে রন্ধ্রে জেকে বসা এসকল সামাজিক সমস্যা প্রতিরোধে এগিয়ে আসতে হবে সমাজকেও। নতুবা এত জঞ্জাল পরিষ্কার  হবার নয়। নববর্ষ উদযাপনের আদর্শ ভুমিকা রাখতে পারে সামাজিক আন্দোলন গড়ে তোলার।  

সমগ্র বিশ্ব আজ ভয়ানক করোনা মহামারিতে বিপর্যস্ত। চলছে রোগ-ব্যাধি, জরা, মহামারির প্রকোপ ও দাপট। দীর্ঘ দুই বছরের ক্ষতি-ধ্বংস ক্রমে ক্রমে স্তিমিত হচ্ছে। নুতন বছরের আবর্তনে আরো কমে যাবে বলে আশা করা যায়। আমরা প্রত্যাশা করি, এবারের বৈশাখ জরা ও রোগ-ব্যাধি কাটিয়ে শক্তিরূপে জাতীয় জীবনে আবির্ভুত হবে।

আবহমান বাংলার ঐতিহ্যকে ধারণ করেই বছর ঘুরে আসে নববর্ষ। সমগ্র জাতি পুরাতনকে পেছনে ফেলে জেগে উঠে নুতন আশায়, নুতন উদ্দিপনায়। এই আশা এবং উদ্দিপনা টিকে থাকে এবং ক্রমশ স্তিমিত হতে থাকে। ধীরে ধীরে সকল উদ্যম, সকল প্রত্যাশা আবার পুরোনো ও মলিন হতে থাকে। এক সময় কালের গর্ভে হারিয়ে যায় বছরটি। আগমনী  বার্তা বয়ে আনে নুতন আরো একটি ভছর। ১৪২৯ বঙ্গাব্দ বয়ে আনুক, সমগ্র জাতির জন্য অনাবিল আনন্দ, সুখ ও সমৃদ্ধি। নতুন বর্ষের আগমনে প্রকৃতি রূদ্ররূপে তার ঊষ্ণ আবহ ছড়িয়ে দেয় চারিদিকে। অগ্নিস্নানে ধরাধাম পবিত্র হয়। পুরোনো বছরের সকল মলিনতা স্নাত হয়ে পরিচ্ছন্ন হয়। পুরোনো বছরের সমস্ত আবর্জনা-অবসাদ-ক্লান্তি দুরিভুত হয়। এবারও নতুনকে আহবানের পালায় এক অপার সম্ভাবনা আর অনাবিল আনন্দযজ্ঞের দিশারী হিসেবে ভরে উঠুক। চৈত্র সংক্রান্তির শেষ লগ্নে নববর্ষকে বরণের অদম্য আকুলতায় নুতন উৎসবের সাজে সজ্জিত হোক ধরাধাম। সমগ্র জাতির আহবানে মুখরিত হোক ১৪২৯ বঙ্গাব্দের পহেলা বৈশাখ।

রবিঠাকুর তাঁর রচনায় লিখেছেন: ‘আমারে তুমি অশেষ করেছ, এমন লীলা তব/ ফুরায়ে ফেলে আবার ভরেছ জীবন নব নব’। তিনি সান্তনা জুগিয়ে বলেছেন- ‘বরিষ ধরা মাঝে শান্তির বারি/ শুষ্ক হৃদয় লয়ে আছে দাড়াঁয়ে/ ঊর্ধমুখে নর-নারী/ না থাকে অন্ধকার, না থাকে মোহপাপ/ না থাকে শোক-পরিতাপ/ হৃদয় বিমল হোক, প্রাণ সবল হোক, বিঘ্ন দাও অপসারি’। বৈশাখের অগ্নিস্নানে এ ধরা আবার শুচি হোক, পূন্য হোক সকলের।