আমাদের ক্ষমা করবেন স্বপন কুমার বিশ্বাস। শিক্ষক হয়ে আমরা পাপ করেছি! শিক্ষক হয়েছি বলে আমাদের করার কিছু নেই। বছরের পর বছর আমাদের লাঞ্চিত, বঞ্চিত, অপমানিত হতে হবে। আমাদের না আছে কাড়ি কাড়ি টাকা না আছে পেশি শক্তি। স্বল্প পারিশ্রমিকের বিনিময়ে শুধু জ্ঞানের আলো ছড়িয়ে দিতে হবে। আমাদের অনেক বিশেষনে বিশেষিত করা হয়। শিক্ষকতা- মহান পেশা, মানুষ গড়ার কারিগর আমরা।

 


শিক্ষক স্বপন কুমারকে যখন জুতার মালা পরানো হয় তখন দেশের প্রায় এককোটি শিক্ষককে জুতার মালা পরানো হয়েছে। এ দৃশ্য যখন দেখি তখন ঘৃনায়, লজ্জায়, অপমানে মরে যেতে ইচ্ছে করে। মনে হয় এ দেশে শিক্ষক হয়ে অপরাধ করেছি। এই অর্থে অপরাধ করেছেন আমার বাবা, আমার স্ত্রী, আমার শিক্ষক, শিক্ষকেরও শিক্ষক।

 

নড়াইলে মির্জাপুর ইউনাইটেড কলেজের অধ্যক্ষ স্বপন কুমার বিশ্বাসকে ধর্ম অবমাননাকারী ছাত্রকে নিরাপত্তায় নেওয়ার অপরাধে হেনস্থার শিকার হতে হয়েছে। পুলিশের উপস্থিতে ওই শিক্ষককে জুতার মালা পরানো হয়েছে।

 

স্থানীয়দের ভাষ্য অনুযায়ী, ১৭ জুন ওই কলেজের এক ছাত্র ভারতের বিজেপি নেত্রী নুপুর শর্মার বিতর্কিত এক বক্তব্য দিয়ে কলেজে আসলে এ নিয়ে উত্তেজনা দেখা দেয়। ছাত্রটি ভয়ে অধ্যক্ষের কার্যালয়ে আশ্রয় নেয়। কিছুক্ষনের মধ্যে, 'অধ্যক্ষ ওই ছাত্রের পক্ষ নিয়েছেন' গুজব ছড়ালে উত্তেজনা দেখা দেয়।

 

এ সময় উত্তেজিত ছাত্র ও এলাকাবাসী দু'জন শিক্ষকের মোটরসাইকেল পুড়িয়ে দেয়। অধ্যক্ষ পুলিশকে খবর দিলে ঘটনাস্থলে ছাত্র ও এলাকাবাসী   অধ্যক্ষের গলায় জুতায় জুতার মালা পরিয়ে ক্ষমা চাইতে বলে।

 

কতটুকু বর্বর, অসভ্য, ইতর, অমানুষ, অসহিঞ্চু হলে মানুষ এ কাজটি করতে পারে। একজন শিক্ষকের প্রথম কাজ হচ্ছে ছাত্রকে আশ্রয় দেওয়া। অপরাধী হলে তার বিচার অবশ্যই হবে। পুলিশকে খবরও দিয়েছেন তিনি। এরপরও ন্যক্কারজনক এ ঘটনা শিক্ষক সমাজ চুপ থাকতে পারে না।

 

সাভারের আশুলিয়ায় ছাত্রের ক্রিকেট স্ট্যাম্পের আঘাতে মারা গেছেন শিক্ষক উৎপল কুমার সরকার। ২৫ জুন শনিবার ইউনুছ আলী স্কুল অ্যান্ড কলেজে মেয়েদের ক্রিকেট খেলা চলছিল। উৎপল কুমার সরকার মাঠের পাশে দাড়িয়ে খেলা দেখছিলেন। ইভটিজিংয়ে বাধা দেওয়ায় অভিযুক্ত ছাত্র মাঠ থেকে ক্রিকেট খেলার স্ট্যাম্প নিয়ে এলোপাথারি আঘাত করে। শিক্ষককে দ্রুত হাসপাতালে নেওয়া হলে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান তিনি।


এর আগে ধর্ম অবমাননার অভিযোগ তুলে মুন্সিগঞ্জের বিনোদপুর রাজকুমার উচ্চবিদ্যালয়ের বিজ্ঞান শিক্ষক হ্রদয় চন্দ্র মন্ডলকে লাঞ্চিত করা হয়েছে। তাকে কারাগারে পর্যন্ত যেতে হয়েছে। ২০১৬ সালে নারায়নগঞ্জের পিয়ার সাত্তার লতিফ উচ্চবিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক শ্যামল কান্তি ভক্তকে ধর্ম অবমাননার অভিযোগে একজন সংসদ সদস্য কান ধরে ওঠ বস করিয়েছেন। সে ঘটনারও কোনো বিচার হয়নি।

 

কারো বিরুদ্ধে ধর্ম নিয়ে কটুক্তির অভিযোগ উঠলেই তাকে মারধর করা, চাপাতি দিয়ে কুপানো, ক্রিকেট স্ট্যাম্প দিয়ে পিঠিয়ে মেরে ফেলতে হবে?

 

শিক্ষকরা মূলত ভদ্র, বিনয়ী, শান্ত,সৌম্য। এ কারনে অভদ্রদের পক্ষে এ কাজগুলো করা সম্ভব হয়। তাদের আমরা ক্ষমা করে দেই, ক্ষমা করতে পারি। কিন্তু সমাজ- রাষ্টের কি কিছু কারার নাই?

 

লেখক- শিক্ষক, বালাগঞ্জ সরকারি ডিগ্রী কলেজ।