বিশ্বকাপ ফুটবলকে কেন্দ্র করে পুরো বাঙালি জাতিই যেনো দুই ভাগ হয়ে যায়। পাড়ায় পাড়ায় চায়ের দোকান থেকে শুরু করে খাওয়ার টেবিল পর্যন্ত আর্জেন্টিনা-ব্রাজিল সমর্থকদের কথার লড়াই চলতে থাকে। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে চলতে থাকে যুক্তিতর্কের লড়াই।

ব্যাপারটা যদি এই পর্যন্ত সীমাবদ্ধ থাকতো তবে এটাকে বিশ্বকাপের উন্মাদনা কিংবা আনন্দ বিনোদনের উপলক্ষ হিসেবে মেনে নেয়া যেতো। তবে বর্তমানে এই কথার লড়াই বৈঠক আর সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ছাড়িয়ে একেবারে রাজপথে এসে ঠেকেছে।


যে রাজপথে মিছিল করে বাঙালি জাতি নিজেদের ভাষার অধিকার আদায় করেছে, যে রাজপথে আন্দোলনের মাধ্যমে দেশে স্বাধীনতা সংগ্রামের সূচনা হয়েছে এবং মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে দেশ স্বাধীন হয়েছে। যে রাজপথে আন্দোলনের মাধ্যমে স্বৈরাচারের পতন ঘটিয়ে দেশে গণতন্ত্র ফিরিয়ে আনা হয়েছে, সেই রাজপথে এখন গভীর রাতে বিকট শব্দ দূষণের মাধ্যমে মিছিল হয় ব্রাজিল আর আর্জেন্টিনার নামে। এটাকে কোনোভাবেই বিশ্বকাপ উন্মাদনার নাম দিয়ে বৈধ করার সুযোগ নেই। একটা স্বাধীন সার্বভৌম দেশের যুব সমাজ বিশ্বের অন্য একটি দেশের একটি খেলার জয়ের উদযাপনের জন্য গভীর রাতে রাজপথে নেমে আসবে, এটা সে জাতির জন্য ভয়ংকর এক অশনি সংকেত বলে আমি মনে করি।

এবার আসি নৈতিক অবক্ষয়ের আলোচনায়। খেলায় যেকোনো দলের সমর্থন আমরা দিতেই পারি সেটা সেই নির্দিষ্ট সময় পর্যন্তই সীমাবদ্ধ থাকা উচিত এবং খেলাশেষে নিজের স্বাভাবিক কাজকর্মে মনযোগ দেয়া উচিত। কিন্তু এই খেলাকে কেন্দ্র করে যে মানসিক চাপ এবং রেষারেষি আমাদের দেশের মানুষের মধ্যে চলে আসছে এটা নৈতিক অবক্ষয়ের পর্যায়েই পড়ে। অন্য একটি দেশের ফুটবলকে সমর্থন দিতে গিয়ে নিজের অতি আপনজন, বন্ধুবান্ধব, আত্মীয়ের সাথে চরমতম খারাপ ব্যবহার করা হয় যা একপর্যায়ে সম্পর্ক নষ্টের কারন হয়ে দাঁড়ায়। নিজের দলের সমর্থনে গলা ফাটানো সমর্থকের দল যখন মাঠে ভালো খেলা উপহার দিতে পারে না কিংবা হেরে যায় তখন সমর্থকদের আত্মহত্যার ঘটনা এবং হার্ট এটাকে মারা যাওয়ার ঘটনাও ঘটেছে। এটা কোনোভাবেই কাম্য নয়।

এবার আসি আইনগত বিষয় নিয়ে। বিশ্বকাপ ফুটবল শুরু হওয়ার আগে থেকেই বিভিন্ন দেশের পতাকা দিয়ে ছেয়ে যায় বাসা বাড়ির ছাদ। এমনকি পুরো এলাকার রাস্তাজুড়ে টানানো হয় ভিন্ন এক দেশের পতাকা। দেখে বুঝার কোনো উপায় নেই এটা স্বাধীন সার্বভৌম এক দেশ। অথচ এই পতাকা অর্জনের জন্য ৩০ লাখ মানুষ শহিদ হয়েছেন, দুই লাখ মা-বোন নিজের সম্ভ্রম হারিয়েছেন। বাংলাদেশে একটি পতাকা আইনও আছে। সেই আইনে নিজ দেশের পতাকা ও ভিন্ন দেশের পতাকা টানানোর বিষয়গুলো স্পষ্ট করা আছে। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য কিছু কথা তুলে ধরছি- সরকারি অফিস আদালত ব্যতীত কোনো বাসা বাড়িতে কোনো সাধারণ দিবসে জাতীয় পতাকা টানানো যাবে না। নির্দিষ্ট কিছু সাংবিধানিক পদমর্যাদার অধিকারী ব্যক্তির গাড়ি ব্যতীত অন্যকোনো গাড়িতে কোনো সাধারণ দিবসে জাতীয় পতাকা টানানো যাবে না। শুধুমাত্র স্বাধীনতা দিবস, বিজয় দিবস এবং সরকার কর্তৃক প্রজ্ঞাপিত দিবসে দেশের সর্বত্র পতাকা টানানো যাবে। যেখানে নিজ দেশের পতাকা জাতীয় দিবস ছাড়া টানানোর কোনো বিধান নেই সেখানে ভিন্ন দেশের পতাকা টানানোর কোনো সুযোগই নেই।

এখন দেখি ভিন্ন দেশের পতাকা টানানোর ব্যপারে আইনে কি বলা আছে- বাংলাদেশে অবস্থিত কূটনৈতিক অফিস গুলোতে বিদেশী পতাকা ব্যবহার করা যাবে এবং বিদেশী রাষ্ট্রপ্রধান, ভ্রমনরত প্রধানমন্ত্রী, মন্ত্রীবর্গ তাদের গাড়িতে নিজ দেশের পতাকা ব্যবহার করতে পারবেন তবে শর্ত থাকে যে বাংলাদেশের পতাকাও সম্মানজনক স্থানে পাশাপাশি উত্তোলন করতে হবে।

পতাকা আইনের একেবারে শেষে বলা হয়েছে- "উপরিউক্ত বিধিসমূহের বর্ণনাব্যতীত, গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের সুনির্দিষ্ট অনুমোদন ব্যতীত, বিদেশী রাষ্ট্রের পতাকা কোনো গাড়ি বা ভবনে উত্তোলন করা যাইবে না।"

অথচ দেদারসে আমাদের বাসা বাড়ি, রাস্তাঘাট, বাজার সব জায়গায় ভিন্ন দেশের পতাকায় ছেয়ে গেছে। এটা আমাদের জাতিসত্তার চরম অবক্ষয়, আইনগত অবৈধ এবং রাষ্ট্রহদ্রোহিতার শামিল। বাংলাদেশ সরকারের উচিত অন্তত পতাকা আইনের যথাযথ প্রয়োগ করা।


সিলেটভিউ২৪ডটকম/পিডি